ভারত সফরে এসেছিলেন লিওনেল মেসি। শনিবার গভীর রাতে কলকাতায় পা রাখেন ফুটবলের রাজপুত্র। প্রিয় তারকাকে এক ঝলক দেখার আশায় রাত থেকেই শহরের নানা প্রান্তে ভিড় জমাতে শুরু করেন অনুরাগীরা। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন ঘিরে তৈরি হয় প্রবল উত্তেজনা—একটাই বাসনা, বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টিনার মহাতারকাকে অন্তত একবার নিজের চোখে দেখা। কিন্তু সেই উন্মাদনার মাঝেই তৈরি হয় চরম বিশৃঙ্খলা। অভিযোগ ওঠে, বহু দর্শক নিজের পকেটের টাকা খরচ করে এলেও মাঠে মেসিকে ঠিকমতো দেখার সুযোগ পাননি। প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন সাধারণ মানুষ। বিশৃঙ্খলার কারণে টুইটারে ক্ষমা চাইতে হয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়কে।

সেদিন যা ঘটে যায়, তার আঁচ এসে পড়ে টলিউডের গায়েও। কারণ অনেকেই সেদিন উপস্থিত ছিল মেসি-দর্শন করতে। ফেডারেশনের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস বলেন, “যে ঘটনাটি ঘটেছে, তা উচিত হয়নি। আরও সতর্ক হওয়া উচিত। যিনি অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেছেন, তাঁরও একটা ভুল ছিল। সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানটি পরিচালনার সরকারের হাতে দিলে বোধ হয় ভাল হত। তিনি সবটাই নিজের হাতে রেখেছিলেন। সকলের সঙ্গে আলোচনা করে পরিকল্পনা করলে এই পরিস্থিতি এড়ানো যেত।”

প্রসঙ্গত, এই ঘটনার পর স্বরূপের দাদা তথা ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসও সমালোচনার মুখে পড়েন। মেসির সঙ্গে ছবি তোলার প্রতি তাঁর অতিরিক্ত আগ্রহ দেখে স্টেডিয়ামে উপস্থিত বহু অনুরাগী ক্ষোভ প্রকাশ করেন। স্বরূপ যদিও পুরো ঘটনার জন্য দায়ী করেছেন সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব এবং বিশৃঙ্খলাকেই। তাঁর কথায়, “ওই মাঠেই কিন্তু আমরা মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গলের মতো উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচের আয়োজন করেছি। সেই ম্যাচ যদি সুসংগঠিতভাবে সম্পন্ন হয়, সেখানে এরকম একটা ঘটনা ঘটবে কেন। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। মানুষ টিকিট কেটেও কেন দেখতে পেলেন না! বাইরের রাজ্যেও কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী এবং ক্রীড়ামন্ত্রী ছিলেন কারণ তাঁদের থাকতে হয়। এখানে না থাকলে সমালোচনা হত যে ক্রীড়ামন্ত্রী মেসির সঙ্গে নেই কেন। কেউ কেউ বলছেন উনি (অরূপ বিশ্বাস) মেসিকে গার্ড করে রেখেছিলেন। কিন্তু আমি সেই বিষয়ে বলতে পারব না কারণ আমি মাঠে ছিলাম না। আমি জানিও না কী হয়েছে। কিন্তু যা ঘটেছে, তা দুর্ভাগ্যজনক।”

মেসিকে ঘিরে চরম বিশৃঙ্খলার ঘটনায় ব্যথিত অভিনেতা তথা তৃণমূল সাংসদ দেবও। তাঁর কথায়, “যাঁরা শুধু গিয়েছেন, তাঁদের জন্য নয়। আমার মনে হয়, বাংলার মানুষের জন্য একটা দাগ হয়। আমরা শিল্পপ্রেমী মানুষ। এখানে এত বড় বড় ইভেন্ট হয়। অরিজিৎ সিংয়ের মতো শিল্পী আসেন। হাজার হাজার মানুষ তাঁকে দেখতে আসে। একটা ঘটনা আমাদের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করল। আমার খুব কষ্ট হয়েছে। বাংলায় আমরা করতে পারিনি। অন্য রাজ্য সেটা করে দেখাল। যা ঘটেছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু আমরা ঘুরে দাঁড়াব।”

অঙ্কুশের মতে, নিজের পরিশ্রমের অর্থ ব্যয় করে টিকিট কেটে মেসিকে দেখতে আসা দর্শকদের সঙ্গে অবিচার করা হয়েছে। তিনি বলেন, “এমন অনেক মানুষ ওখানে গিয়েছেন যাঁদের সারা মাসের মাইনে দিয়ে হয়তো একটা টিকিট কিনতে হয়েছে। পরের বার এত বড় তারকাকে আনার আগে আরও সতর্ক থাকতে হবে। মেসির মতো একজন তারকার ক্ষেত্রেও সেভাবেই পরিকল্পনা করা উচিত ছিল। মেসিকে মানুষ পুজো করেন। তাঁদের চোখের জল দেখতে খুব খারাপ লাগছে।”

প্রেমিকের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন ঐন্দ্রিলা। তাঁর কথায়, “সকলেই হয়তো সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানটা করার চেষ্টা করেছিলেন। তবু কোনও ভাবে বিষয়টা আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়েছে। এটাই চাইব, কলকাতার আর যাতে বদনাম না হয়। ঠিক করে পরিকল্পনা করেই যেন করা হয়। ট্রোলিং, গালিগালাজটা সমাধান নয়। বরং ভুল শুধরে নেওয়াই কাজের কাজ। আর আমরাও যাতে মানুষ হিসাবে পাশে থাকতে পারি। এমন পরিস্থিতি যাতে না তৈরি হয়, সেই চেষ্টাই করতে হবে।”

অরিন্দম শীল অতীতের পাতা উল্টে দেখেছেন। মনে করিয়ে দিয়েছেন, ২০১১ সালে মেসি যখন কলকাতায় আসেন, তখন এমন কোনও অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেনি। তাঁর কথায়, “সংগঠকদের অপেশাদার আচরণের জন্য এই ঘটনা ঘটেছে। এটা বাংলার লজ্জা। আমাদের লজ্জা। মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষমা পর্যন্ত চাইতে হয়েছে! খুব লজ্জার ব্যাপার। কত মানুষ দূর থেকে এসেও মেসিকে দেখতে পাননি। এটা খুবই দুঃখজনক। আমি নিজেই ওঁকে টেলিভিশনে দেখতে পাইনি। শুধু ওঁর চারপাশে কালো মাথার ভিড়। বুঝতেই পারছিলাম ক্যামেরা ওঁকে ঠিক করে ধরতে পারছে না।”

এখানেই থামেননি অরিন্দম। তিনি কলকাতার সঙ্গে হায়দরাবাদ ও মুম্বইয়ের তুলনা টেনে জানান, ওই শহরগুলিতে অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। তাঁর অভিযোগ, আয়োজকদের অপেশাদার মনোভাব ও চরম অসতর্কতার কারণেই আজ শহরকে লজ্জার মুখে পড়তে হয়েছে।

শনিবার মেসিকে দেখতে মাঠে উপস্থিত ছিলেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ও। বিদেশে একাধিক বার ফুটবলের রাজপুত্রের খেলা দেখলেও আরও একবার তাঁকে চাক্ষুষ করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি অভিনেতা। তাঁর কথায়, “কেউ মেসিকে দেখতে পেলেন। কেউ পেলেন না। এরকম অবস্থায় যে একটা দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি তৈরি হল, তাতে কেউ খুশি হতে পারেননি। না দর্শক, না আয়োজক, না সরকারের লোক। এমন একটা ক্ষোভের দিন তো আমাদের শহরেই থেকে গেল। কীভাবে খুশি হব। এরকম ঘটনা না হলেই পারত। ফুটবলের শহরে বহু বছর আগেও এরকম একটা দুর্ঘটনা হয়েছিল মাঠে গণ্ডগোল হয়ে। আসলে দুর্ঘটনার কোনও পরিকল্পনা বা ব্লু প্রিন্ট হয় না। তাই দোষাদুষি না করে আমাদের একটু খেয়াল রাখতে হবে। বুঝতে হবে মানুষকে ডাকলে আমাদের কী কী নিয়ম মেনে চলা উচিত।” তবু হাল ছাড়তে নারাজ কৌশিক। তাঁর আশা, ফের শহরে আসবেন মেসি। আর তাঁকে প্রাণ ভরে দেখবেন অনুরাগীরা।