আজকাল ওয়েবডেস্ক: নেমে এল পর্দা। প্রয়াত শ্যাম বেনেগাল। 

পরাধীন ভারতে ১৯৩৪ সালে ১৪ ডিসেম্বর জন্ম হয়েছিল শ্যাম বেনেগালের। সেই ডিসেম্বরের ২৩ তারিখেই  ৯০ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের দিকপাল শ্যাম। সম্প্রতি তাঁর তৈরি মন্থন ছবিটি নতুন করে মুক্তি পেয়েছিল, সর্বত্র সেই নিয়ে আলোচনা ছিল তুঙ্গে। এত বছর পরে এসেও তিনি ছিলেন একাধিক আলোচনার কেন্দ্রে। গত ১৪ ডিসেম্বর, ৯০তম জন্মদিন কাটিয়েছিলেন পরিবারের সঙ্গে। সেই অধ্যায়ের যেন পরিসমাপ্তি হল আজ। বছর শেষে চলচ্চিত্র জগতের এক মহিরূহের পতন শোকস্তব্ধ করল শিল্প, সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্র জগতকে। 

হায়দরাবাদের পরিবারে ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন শ্যাম বেনেগাল। কর্ণাটকের আদি বাসিন্দা শ্যামের পরিবারে আগাগোড়া ছিল শিল্প সংস্কৃতির ছোঁয়া। ইন্টারনেট বলছে, মাত্র ১২ বছর বয়সে প্রথম ছবিটি বানিয়েছিলেন শ্যাম। বাবা শ্রীধর বি বেনেগালের উপহার দেওয়া ক্যামেরায় তৈরি হয়েছিল তাঁর প্রথম ছবি। প্রথাগত শিক্ষার ধারায় তিনি হায়দরাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পাশ করেন। তাঁর হাত দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল হায়দরাবাদ ফিল্ম সোসাইটি। 

১৯৫৯ সালে তিনি একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার কপিরাইটার হিসাবে কাজ শুরু করেন। তিনি সেই সংস্থার ক্রিয়েটিভ হেড পদে ছিলেন। তিনি ১৯৬২ সালে প্রথম তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন গুজরাতি ভাষায়, ছবির নাম ছিল ঘর বেঠা গঙ্গা। কিন্তু তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও ১২ বছর। 

১৯৭৩ সালে তিনি তাঁর প্রথম ছবি অঙ্কুর তৈরি করেন। তাঁর প্রতিভার বিস্ফোরণ চমকে দেয় বিশ্বকে। তিনি তাঁর ছবিতে অভিনয় জগতের সঙ্গে পরিচয় করান শাবানা আজমি, অনন্ত নাগের মতো অভিনেতাদের। চলচ্চিত্র গবেষণার ভাষায় বলা হয়, ১৯৭০-'৮০ দশকে নিউ ইন্ডিয়া সিনেমার যে উত্থান ভারত দেখেছিল, তাঁর অন্যতম পুরোধা ছিলেন শ্যাম। তিনিই সেই সময় এফটিআইআই পুণে ও দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার বিভিন্ন সেই সময়ে অনামি, অপরিচিত অথচ প্রতিভাধর অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করেছিলেন। সেই তালিকায় ছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ, ওম পুরি, স্মিতা পাটিল, শাবানা আজমি, কুলভূষণ খারবান্দা ও আমরেস পুরীরা। 

১৯৭৫ সালে তাঁর নিশান্ত ছবিটি মুক্তি পায়। তার ঠিক পরের বছর ১৯৭৬ সালে মুক্তি পায় মন্থন। গুজরাতের ডেয়ারি শিল্প ও ভারতের বিখ্যাত মাদার ডেয়ারির প্রতিষ্ঠাতা  ভার্গিস কুরেনকে নিয়ে এই ছবি উচ্চ প্রশংসিত হয়। এই ছবিটি তৈরি করতে ডেয়ারি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য মানুষেরা মাথাপিছু দু'টাকা করে দিয়েছিলেন, সেই টাকায় তৈরি হয় এই ছবি। ১৯৭৭ সালে ভূমিকা নামে একটি ছবি তৈরি করেন শ্যাম। ১৯৮৭-৮৮ থেকে পরপর তাঁর তৈরি ছবি আলোচনার কেন্দ্রে আসে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়ার উপর নির্ভর করে তৈরি টেলিভিশনের কাজ ভারত এক খোঁজ তিনি তৈরি করেন ১৯৮৮ সালে। এর বাইরেও তিনি ১৯৮০ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত তিনি ফিল্ম ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনের ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করেন। 

এমনই বিস্তৃত সিনেমা যাপনে তাঁর কাছে এসে ধরা দিয়েছেন সত্যজিৎ রায়ও। সত্যজিতকে ঘিরে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন। ২০০১ সালের জুবেইদা, ১৯৯৬ সালে সর্দারি বেগম সিনেমা মাস্টারির এক উল্লেখযোগ্য পাঠ হিসাবে ধরেন সমালোচকরা। নেতাজি সুভাষের জীবন নিয়ে বোস দ্যা ফরগটন হিরো ছবিটি তৈরি করেছিলেন শ্যাম, যা জনপ্রিয়ও হয়েছিল বিপুল। ২০০৪ সালের এই ছবি বাঙালিকেও ছুঁয়েছিল নানা ভাবে। ২০২৩ সালে, ৯০ ছোঁয়ার মুহূর্তেও তিনি তৈরি করেছিলেন বাংলাদেশের রূপকার শেখ মুজিবকে ঘিরে ছবি, মুজিব, দ্যা মেকিং অফ অ্যা নেশন। সেই ছবি নিয়েও দুই বাংলায় আলোচনা চলেছিল দীর্ঘদিন। 

পুরস্কারের ঝুলিও তাঁর সব সময় ভরাই থেকেছে। তিনি জাতীয় পুরস্কার তো পেয়েছেনই, পেয়েছেন পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ২০১২ সালে তাঁকে ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি ২০১৬ সালে আইটিএম ইউনিভার্সিটি গোয়ালিয়র থেকেও পেয়েছিলেন ডিলিট উপাধি। সব মিলিয়ে দীর্ঘ কর্মজীবনের নানা পর্যায়ে তিনি ছুঁয়েছেন শিল্পের বিভিন্ন পর্যায়গুলিকে।  

ভারতকে অন্য চোখে দেখা, স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের নতুন করে গড়ে ওঠা, তার ওঠাপড়া, এবং প্রান্তীয় মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে সম্পর্কের জটিলতা, সবই উঠে এসেছিল তাঁর ছবিতে। অনুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় দেশের মানুষ, সমাজ ও সময়কে দেখার ও দেখানোর মানুষ শ্যাম, জন্মদিন পালনের ঠিক ন'দিনের মাথায় প্রয়াত হলেন।