‘কেদারা’ থেকে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ হোক বা ‘গৃহপ্রবেশ’— জাঁকজমক নয়, প্রযোজক সমীরণ দাসের কাছে প্রাধান্য পায় বিষয়বস্তু। বক্সঅফিসের লাভ-ক্ষতিকে মাথায় রেখেও অ্যাকশন-গোয়েন্দার ভিড়ে দর্শকের পাতে এনে দিতে চান নতুন স্বাদ। সেই পথে হেটেই এসেছে জাতীয় পুরস্কার, আন্তর্জাতিক খ্যাতি। আলোকবৃত্ত থেকে দূরে থাকা প্রযোজকের কথা শুনলেন আজকাল ডট ইন-এর সঞ্চারী কর।

বর্তমানে বক্স অফিসে  বাণিজ্যিক ছবির রমরমা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত আপনি মূলত বিষয়ভিত্তিক ছবিই প্রযোজনা করেছেন। লাভের অঙ্কের চেয়ে কন্টেন্ট কি তবে বেশি টানে? 

দেখুন, কোয়ালিটি বা মান শব্দটা আপেক্ষিক। কিন্তু আমি মূলত সাহিত্যনির্ভর বা ভাল কন্টেন্ট আছে, এমন বিষয় নিয়েই ছবি করতে ভালবাসি। সেগুলি হয়তো বক্স অফিসে চটজলদি সাফল্য দেবে না। কিন্তু অবশ্যই একটা রয়্যালটি ভ্যালু থাকবে। সেভাবে আমার ‘কেদারা’ করা, ‘বিসমিল্লা’ করা। তারপর ‘গৃহপ্রবেশ’ এবং ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’। এমন ছবিই প্রযোজনা করব, যা মানুষের মনে দাগ ফেলবে।

এমন ছবির ক্ষেত্রে তো ঝুঁকিও প্রচুর। ‘বিসমিল্লা’র বিরুদ্ধে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল…

‘বিসমিল্লা’র ক্ষেত্রে যা যা ঘটেছিল, সেগুলি আমায় ভাবিয়েছিল। আমার কোম্পানি, আমার সহকর্মীদের নানা কটূ কথা শুনতে হয়েছিল। আমাকেও কাফের বলা হয়েছিল। ঋদ্ধি সেন বা ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তকে কী বলা হয়েছিল, তা না হয় ছেড়েই দিলাম। ছবিতে অরিজিৎ সিং গান গেয়েছিলেন বলে, তাঁকেও ট্রোল হতে হয়েছিল। তিনি হয়তো সব কিছুর ঊর্ধ্বে। কিন্তু আমরা তো সাধারণ মানুষ। এই ধরনের আক্রমণ আমাদের গায়ে এসে লাগে। ছবিটা ভাল চলেনি, সেটা আলাদা কথা। কিন্তু মনে হয়েছিল এই ছবিটা করে অন্যায় করে ফেলেছি। আজ যদি আমায় বলেন, আবার ‘বিসমিল্লা’র মতো ছবি করতে, আমি হয়তো ভয় পাব।

অর্থাৎ দিনের শেষে সেই হিসাব কষতেই হয়…

অবশ্যই, বক্স অফিসের লাভ-লোকশান আমাকেও ভাবায়। ব্যবসায়ী হিসাবে যদি আমি দেখি, তা হলে প্রযোজক হয়ে ওঠার একটা জার্নি আছে। প্রথম ছবিটা হিট হয়ে গেল, লাভের টাকা নিয়ে আমি বাড়ি চলে গেলাম, পরের ছবি আর চলল নাকি চলল না, সেদিকে নজর দিলাম না— এভাবে তো এই যাত্রাটা হয় না। প্রথম চারটে ছবি আমায় সেভাবে সাফল্য দেয়নি। ‘গৃহপ্রবেশ’ সুপারহিট, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ প্রশংসিত, ‘কেদারা’ জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। কিন্তু ছবি করার পর তার লাভের টাকায় আমি এখনও বড়লোক প্রযোজক হয়ে উঠতে পারিনি। অর্থের জন্য আমার ব্যবসা আছে। কিন্তু আমি যদি একটি ছবিতে টাকা লগ্নি করে তা একেবারেই না তুলতে পারি, প্রযোজক হিসাবে অবশ্যই গায়ে লাগবে। সেক্ষেত্রে হিসেবিও হতে হবে।

ব্যবসায়ী থেকে প্রযোজক, শিল্পীসত্তার যত্ন নিতেই কি ছবি প্রযোজনায় আসা? 

আমি সেই হিসাবে শিল্পী মানুষ নই। তবে আমার পরিবারে প্রচুর শিল্পী মানুষ ছিলেন। আমার ছোটকাকা সুখেন দাস, মেজোকাকা অজয় দাস। আমাদের পরিবার বাংলার নবজাগরণের সঙ্গেও যুক্ত ছিল। তাই আগাগোড়াই আমার মধ্যে কাজের বাইরে ভাল কিছু করার ইচ্ছা ছিল। সেই ইচ্ছা থেকেই ছবি প্রযোজনায় আসা। আমি ঝুঁকি নিতে ভালবাসি। সোজাসাপ্টা আমার কোনও কিছুই ভাল লাগে না।

আপনার প্রযোজনায় ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ রোটারডাম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও সম্মানিত। এই ধরনের প্রাপ্তি কি বাংলা ছবিকে সত্যিই আরও এগিয়ে নিয়ে যায়?

অবশ্যই নিয়ে যায়। কান, বার্লিন বা রোটারডামের মতো নামী ফেস্টিভ্যালে যখন আমাদের ছবি যায়, তখন তো সেখানে আমরা বাংলাকেই তুলে ধরি। একটা বিষয় বুঝতে হবে যে, সাফল্যকে কিন্তু সব সময় আর্থিক লাভ দিয়ে মেপে দেখা যায় না। সম্মান দিয়েও দেখা যায়। দুটো যদি একসঙ্গে আসে, তবে তার থেকে ভাল কিছু হয় না। ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ এত প্রশংসা পেল। কিন্তু বক্স অফিসেও যদি দারুণ ব্যবসা করত, তা হলে আমরা এরকম আরও ছবি বানানোর সুযোগ পেতাম। 

আপনার ছবি আন্তর্জাতিক মঞ্চে খ্যাতি পেল। জাতীয় পুরস্কারও এনেছে অতীতে। তবু প্রযোজক হিসাবে আলোকবৃত্ত থেকে আপনি দূরে কেন?

দেখুন, এমনটা নয় যে, আমি ইচ্ছা করে দূরে আছি। আবার এমনও নয় যে, আমি লাফিয়ে সামনে আসতে চাই। অনেক ক্ষেত্রেই প্রোটোকলের কথা বলে প্রযোজক বা প্রযোজনা সংস্থার কথা প্রচারে উল্লেখ করা হয় না। অ্যাওয়ার্ডের ক্ষেত্রেও আমাদের কথা বিশেষ মাথায় রাখা হয় না। পরিচালক, অন্যান্য কলাকুশলী এবং অভিনেতাদেরই শুধু পুরস্কৃত করা হয়। আমার মনে হয়, ‘সেরা ছবি’র পুরস্কার প্রযোজকেরই পাওয়া উচিত। সঙ্গে পরিচালকও থাকতে পারেন। এমনকি, অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে বসার জায়গাতেও আমার সিট পিছনের দিকে থাকে। আবার বহু নবাগত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা থাকেন সামনে সারিতে। এই সম্মানগুলো কিন্তু আমাদেরও প্রাপ্য। তাঁদের গ্ল্যামার আছে বলে হয়তো সামনের দিকে থাকেন। আমাদের নেই, তাই আমরা থাকি না। কিন্তু আমার মনে হয়, ছবির সাফল্যে কৃতিত্ব একজন প্রযোজকেরও পাওয়া উচিত।

হিন্দি ছবির বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়াইয়ের পর পুজোতে চারটি বড় বাজেটে ছবির শো পাওয়া নিয়ে দ্বন্দ্ব…

আমার মনে হয়, আমরা আদৌ একজোট হইনি। কোনও অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে কেউ পুরস্কার পেলে একে অপরের জন্য হাততালি দেওয়া আমার চোখে একজোট হওয়া নয়। মাঠে নেমে লড়াইয়ের সময় কেউ দলবদ্ধ হয় না। সবার নিজস্ব গ্রুপ আছে। আবার তাতেও ছোট ছোট সাবগ্রুপ আছে। ক’টা প্রেক্ষাগৃহ আছে, সেটা হিসেব করলে একসঙ্গে কি এতগুলো ছবি মুক্তি পেতে পারে? যে যার মতো করে বেশি শো পাওয়ার চেষ্টা করবেই। তাকে দোষ দেওয়া যায় না। সবাই নিজের কথা আগে ভাবে। যে লাভবান হয়, সে খুশি। যে হয় না, সে অভিযোগ করে।

এত ছবি, এত ব্যবসার মাঝেও কেন বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ করতে হচ্ছে?

আসলে কথাটা হওয়া উচিত, বাংলা ভাষার পাশে দাঁড়ান। আমরা তো ভাষাটেই সম্মান করতে ভুলে যাচ্ছি। যে ভাষা নিয়েই আমরা সচেতন নই, সেই ভাষায় তৈরি ছবি নিয়ে কী আগ্রহ দেখাব! বাংলা ভাষার জন্য আমাদের আবেগ হারিয়ে গেলে ছবি কী ভাবে চলবে বলুন…

বাংলার মেয়ে অনুপর্ণা রায় ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত। বাংলায় তিনি বিষয়ভিত্তিক ছবি বানাতে চাইলে প্রযোজনা করবেন? 

আমি চাই, ঈশ্বর আমাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যান, যেখানে আমি ওঁর মতো শিল্পীদের ফোন করে কাজ করার প্রস্তাব দিতে পারব। কিন্তু এখনও সেই জায়গাটায় আসিনি। যেদিন আসব, প্রত্যেকটা ভাল শিল্পীকে বলতে চাইব, আমি তাঁদের পাশি আছি।