আজকাল ওয়েবডেস্ক: ১৭৭ বছর আগে লেখা এক বিপ্লবী দলিল মিলিয়ে দিল রবীন্দ্রনাথ ও কার্ল মার্ক্সকে! কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো, যা ডাক দিয়েছিল— “বিশ্বের শ্রমিকরা এক হও” এবং পুঁজিবাদের পতন ঘটিয়ে সবার জন্য সমান সমাজ গড়ার- তা'ই একেবারে চূড়ান্ত পুঁজিবাদী শ্রমনির্ভর কুইক-কমার্স প্ল্যাটফর্ম-এ বিকোচ্ছে হাত কেক-এর মতো! শনিবার (৯ আগস্ট) সারা দেশে যখন রাখিবন্ধন পালিত হচ্ছে, তখন গুরগাঁও-ভিত্তিক ১২ বছরের ব্লিঙ্কিট তাদের “গিফটস ফর সিস্টার্স” সেকশনে ফেলুদা সমগ্রের প্রথম খণ্ডের পাশে সাজিয়ে রাখল কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস রচিত কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো— দাম মাত্র ১২৯ টাকা!
ভাবা যায়, কলকাতার এক 'সর্বহারা' গিগ ডেলিভারি বয়— যাকে ১৯শ শতকে মার্ক্সের সময় বলা হত ‘প্রলেতারিয়েত ’— আজকের দিনে প্রতিদিন মাত্র ৭ ডলারের একটু বেশি উপার্জন করছে, ব্যস্ত ট্রাফিক আর গলির ভিড় পেরিয়ে, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়চ্ছে, হাতে নিয়ে মার্ক্সের বিপ্লবী বই, যাতে গ্রাহকের কাছে পৌঁছায় ১৬ মিনিটে! মার্ক্স হয়তো এই দৃশ্য দেখে বলতেন— “সর্বনিম্ন মজুরি মানে এমনটা, যাতে শ্রমিক শুধু বেঁচে থাকতে পারে, পরিবার চালাতে পারে, এবং শ্রমিকজাতি বিলীন না হয়ে থাকে— ঠিক যেমন গবাদিপশুর জীবন।”
রাখির দিনে গিফট সেকশন থেকে বইটি সরে গেলেও, ব্লিঙ্কিটে এখনও পাওয়া যাচ্ছে একই দামে। অন্যদিকে, জেফ বেজোসের অ্যামাজনে বইটি ১২২ টাকায়, কিন্ডল সংস্করণ ২৪ টাকায়, আর অডিও সংস্করণ বিনামূল্যে। ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে লন্ডনের লিভারপুল স্ট্রিটে প্রথম প্রকাশিত এই বইটি মাত্র ২৩ পৃষ্ঠার ছিল। আজ এটি বিশ্বের প্রায় ২০০ ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বিক্রি হয়েছে ৫০ কোটিরও বেশি কপি, এবং আইভি লিগসহ বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন্যতম সর্বাধিক পড়ানো বই।
তবে ভারতের গিগ ইকোনমির বাস্তবতা ভিন্ন— ২০২০ সালে ৭.৭ মিলিয়ন গিগ কর্মী বছরে ১ বিলিয়ন ডলার যোগান দিলেও তারা এখনও অতিশ্রম, স্বল্পমজুরি, সামাজিক সুরক্ষাহীনতার শিকার— অনেকটা সেই ১৭৭ বছর আগেকার শ্রমিকদের মতো, যাদের জন্য মার্ক্স কলম ধরেছিলেন। এই রাখিবন্ধনে তাই দৃশ্যটা ছিল একেবারে প্রতীকী— সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনের দিন, পুঁজিবাদের ডেলিভারি চক্রে চেপে, ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল বিপ্লবের আহ্বান।
আরও পড়ুন: রাহুলের বিস্ফোরক অভিযোগে আক্রমণ কমিশনের: 'হুমকি না দিয়ে ডিজিটাল ভোটার লিস্ট দিন', পালটা রাহুল
১৯২৯ সালের ওয়াল স্ট্রিট ধস এবং পরবর্তী মহামন্দার সময় (১৯৩০,২০০৬) কার্ল মার্ক্সের কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো (১৮৪৮) ও দাস ক্যাপিটাল (১৮৬৭) পুঁজিবাদী বিশ্বে অভূতপূর্ব বিক্রির মুখ দেখেছিল। আর্থিক বাজার ধসে পড়া, বেকারত্বের বিস্ফোরণ, লক্ষ লক্ষ মানুষের সঞ্চয় উবে যাওয়া—এই প্রেক্ষাপটে অবাধ বাজারনীতির ভিত কেঁপে উঠেছিল। এমন অর্থনৈতিক হতাশা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সময়ে পুঁজিবাদ নিয়ে মার্ক্সের কঠোর সমালোচনা নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিল।
সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র আহ্বানে ভরা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো শ্রমিক ঐক্য ও বিপ্লবের মন্ত্রে পরিণত হয়েছিল। অন্যদিকে, দাস ক্যাপিটাল—যেখানে মার্ক্স উদ্বৃত্ত মূল্য, শোষণ ও পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত বৈপরীত্য বিশ্লেষণ করেছেন—তা শুধু কর্মী-সংগঠক নয়, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক ও নীতিনির্ধারকদের কাছেও চাহিদাসম্পন্ন হয়ে উঠেছিল, যারা সংকটের শিকড় বুঝতে চাইছিলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি ও ফ্রান্সে প্রকাশকরা ১৯৩০-এর দশকের শুরুতে এই দুই গ্রন্থের জন্য নজিরবিহীন চাহিদার কথা জানান। গ্রন্থাগারে অপেক্ষমান পাঠকের লম্বা তালিকা তৈরি হয়, আর বামপন্থী পাঠচক্র গড়ে ওঠে দ্রুত। ঘটনাটি প্রমাণ করেছিল—গভীর পুঁজিবাদী সংকট পুরনো মার্ক্সবাদী দলিলকে আবারও জনপ্রিয় করে তুলতে পারে; কয়েক দশক আগে লেখা বই হঠাৎই বেস্টসেলার হয়ে ওঠে, কারণ সমাজ তখন ভেঙে পড়া পুঁজিবাদের বাইরে উত্তর খুঁজছিল।
