শুক্রবার ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪
সম্পূর্ণ খবর
Sumit | ১২ নভেম্বর ২০২৪ ২০ : ৩৩Sumit Chakraborty
জয়ন্ত ঘোষাল : দার্জিলিং মেঘেরই রাজ্য। পাহাড়ের মানুষ যেন মেঘের মধ্যেই বসবাস করে। এমনটা বলেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। দার্জিলিং সম্পর্কে তিনি লেখেন,এ যেন এক মেঘের রাজ্য। আমরা তো নিচুতলায় থাকি। নাগালের মধ্যে মেঘ পাইনা। পাহাড় আর মেঘ এই নিয়েই তো দার্জিলিং। এক অসাধারণ রোমান্টিসিজম। দার্জিলিং শব্দটা এসেছিল ‘দোর্জে’ শব্দ থেকে। ‘দোর্জে’ হল উপাসনালয়। যেখানে বজ্র বিদ্যুতের চমক দেখা যায়। তাকেই বলে ‘দোর্জে’। আর ‘লিং’ শব্দটির অর্থ স্হান। অর্থাৎ বজ্র বিদ্যুতের স্হান হল দার্জিলিং। তা অত উঁচু পর্বতে বিদ্যুৎ চমকিয়া যাবে তাতে আর সন্দেহ কি? কিন্তু এইসব কল্পবিলাসের পাশাপাশি মনে রাখতে হবে দার্জিলিং জন্মলগ্ন থেকেই এক রাজনৈতিক জটিলতা আর সংকটের শিকার । দার্জিলিং হল সিকিম আর নেপালের দুপক্ষের লড়াই। আর সেই লড়াইয়ে তৃতীয়পক্ষ ছিল ব্রিটিশ রাজশক্তি। তারা সিকিমের রাজাকে সমর্থন করে নেপালের গোর্খা সমর বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করলে ।পরে যখন সিকিমরাজ বুঝলেন যে তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে ঠকে গেছেন ,তখন তারা ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়তে গেলে তখন রাজশক্তি পাল্টা আক্রমণ হানে ! নেপালের গোর্খা বাহিনী দার্জিলিং দখল করেছিল। আবার ব্রিটিশ আঘাত হেনেছিল নেপালের গোর্খাদের বিরুদ্ধে। এই টালমাটাল রাজনীতির মধ্যে কখনও সুগৌলি কখনও তিতলিয়া চুক্তি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত লর্ড বেন্টিঙ্ক দার্জিলিং-এ নিয়ে এলেন স্থিতাবস্থা। দুজন অফিসারকে পাঠালেন। তারা এতই মুগ্ধ হয়ে গেলেন যে বললেন , এতো স্বাস্থ্য নিবাসের উত্তম স্থান । লন্ডন থেকে ফিরে এমনিতেই গরমে হাঁসফাঁস করছিল সাহেবরা।এই দার্জিলিং হয়ে উঠল তাদের এক আকর্ষণীয় গন্তব্য।
আজ এতবছর পর সুভাষ ঘিসিং। সুভাষ ঘিসিং-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন বিমল গুরুং। আবার বিমল গুরুং-এর বিরুদ্ধে এলেন অনিত থাপার। পালাবদলের পালা।এই উত্তাল দার্জিলিং বিচ্ছিন্নতা বোধের দার্জিলিং। গোর্খা আন্দোলনের দার্জিলিং। বাঙালি বিরোধিতার দার্জিলিং। এইসব উথালপাথালকে একটা শান্ত রাজনীতির অবস্হানে নিয়ে আসতে আজ সক্ষম হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।
দার্জিলিং-এর ভূখণ্ড নিয়ে সুভাষ ঘিসিং-এর রাজনীতির মোকাবিলা করতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বোঝাপড়ায় এসেছিলেন | রাজীব গান্ধী ঘিসিং-এর সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছিল। এরপর বারবার বিজেপি সেখানে দলীয় সাংসদ সদস্যকে নির্বাচিত করেছে স্থানীয় গোর্খা নেতাদের সমর্থনে। কিন্তু দার্জিলিং-এর বিচ্ছিন্নতাবোধ কাটেনি।
মমতা ব্যানার্জি ক্ষমতায় আসার পর ঠিক কতবার তিনি দার্জিলিং-এ গেছেন তার কোন হিসাব নেই। রাজীব গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন ওঁর সঙ্গে একবার দার্জিলিং গিয়েছিলাম । হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের একটা অনুষ্ঠান ছিল। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুও এসেছিলেন। দুপুরবেলায় প্রধানমন্ত্রী -মুখ্যমন্ত্রী একসঙ্গে লাঞ্চ করেছিলেন। সেই ঘটনারও সাক্ষী বটে। কিন্তু জ্যোতিবাবুকে কখনই খুব ঘনঘন দার্জিলিং আসতে দেখিনি, বরং আনন্দ পাঠকের মত দলীয় সাংসদের উপরেই দার্জিলিংটা ছেড়ে দিয়েছিলেন।
প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন রাষ্ট্রপতি। প্রণববাবুর সঙ্গেও একবার দার্জিলিং গিয়েছিলাম । তখন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। এই দুজনকে নিয়ে মমতা অনেক কর্মসূচি দার্জিলিং-এ নিয়েছিলেন। খাড়া সিড়ি দিয়ে উঠেছিলেন মহাকাল মন্দির ।জনসম্পর্ক অভিযান ছিল সাংঘাতিক । প্রণববাবু রাজভবনে বসে বলেছিলেন , এইরকম দার্জিলিং চষে ফেলা কোন মুখ্যমন্ত্রী এর আগে আমি বাপু দেখেনি!
জ্যোতিবাবুকে কখনও এতবার দার্জিলিং-এ আসতে দেখিনি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকেও ঘন ঘন দার্জিলিং-এ আসতে দেখিনি। শুনেছি সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় মাঝেমধ্যে আসতেন। কিন্তু দার্জিলিং-এ এসে বিশ্রাম নেওয়া আর দার্জিলিং সমস্যার শিকড় অনুসন্ধান করা মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া এসব কিন্তু ভিন্ন । মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে গিয়ে দেখেছি যেভাবে তিনি পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যান , পাহাড়ি মানুষদের ঘরগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটছেন,কখনও বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ছেন। তাদের রান্নাঘরে গিয়ে মোমো রান্না করছেন। সেখানে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছেন। মমতাকে নিয়ে ডাকাডাকি করতে শুরু করে পাহাড়ি মানুষেরা। প্রথম থেকেই বারবার মমতা ব্যানার্জি সেখানে গিয়ে চেষ্টা করেছেন যে দার্জিলিং-এর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্হিরতকে কী করে দমন করা সম্ভব হয়। আর তার জন্য তিনি শিলিগুড়িকে ধরলে প্রায় তেরোটি পরিষদ গঠন করেছেন। শুধু গোর্খাদের জন্য নয়,তিনি ভুটিয়া পরিষদ,তামাং পরিষদ,লেপচা উন্নয়ন পরিষদ একের পর এক পরিষদ নির্মাণ করে তিনি বিভিন্ন জাতি উপজাতির স্বায়ত্তশাসন তাদের নিজস্ব পরিচিতির রাজনীতিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এর ফলে প্রশমিত হয়েছিল আন্তর জাতি -উপজাতি সংঘাত। দার্জিলিং শুধুমাত্র গোর্খাদের নয় সেখানে লেপচারা আছে। ভুটিয়া আছে। আরও কতরকমের সংগঠন আছে। এদের মধ্যে বেশ কিছু সংগঠন রাজনৈতিকভাবে তারা বিজেপির সঙ্গী হয়েছেন। আবার আজ অনিত থাপার দীর্ঘদিন ধরে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা গঠন করে তৃণমূলের সঙ্গী হয়েছেন। এমনকি এই উপনির্বাচনে মাদারিহাটে তৃণমূলের হয়ে প্রচার অভিযানে বেরিয়েছেন। ঘিসিং পুত্র বিজেপির সঙ্গী হয়েছেন। কিন্তু রাজনীতিতে তার প্রাসঙ্গিকতা কমে গেছে। বিমল গুরুং-এর অস্তিত্ব একদম তলানিতে এসে ঠেকেছে। মমতা ব্যানার্জি একদিকে যেরকম গোর্খা কবি ভানুকে স্মরণ করেছেন, তার নামে ভবন গঠন করেছেন। আবার পাহাড়ের অন্যান্য স্হানীয় মনীষীর পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের ছবিকেও জায়গা করে দিয়েছেন।
বেশ কিছুদিন পর মমতা আবার পাহাড়ে ! তিনি একদিকে যেরকম অখন্ড দার্জিলিং এবং সেই দার্জিলিংকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত রাখতে চান আবার সেই দার্জিলিংকে বিচ্ছিন্ন কোনও রাজ্য গঠনের দাবি থেকেও সরিয়ে এনেছেন। এর পাশাপাশি জিটিএ বৈঠকে তিনি কঠোর মনোভাব নিয়েছেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে। উন্নয়ন বিরোধিতার প্রশ্নে। তিনি অডিটের নির্দেশ দিয়েছেন। সমস্ত টাকা পয়সার হিসেবে নিকেশ হবে। মুখ্যসচিবকে দায়িত্ব দিয়েছেন। এমনকি বহু পরিষদ কোটি কোটি টাকা নিয়ে যারা হিসেব ঠিক মত করে দেননি তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দরকার হলে এই উন্নয়নমূলক পরিষদগুলোর কার্যকারিতা খতিয়ে দেখা হবে। এগুলোর পর্যালোচনা করে দরকার হলে পুরনো সংগঠন বন্ধ করে দিয়ে নুতন সংগঠন তৈরি করা হবে জিটিএ বৈঠকে এই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি । অনেকদিন পর তিনি দার্জিলিং-এ এসেছেন। ভালবাসা যেমন তিনি দিয়েছেন পাহাড়ের মানুষকে ঠিক সেইভাবে পাহাড়ি নেতাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করেছেন। বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন যে পাহাড়কে সমতলের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া অনুচিত আওয়াজ তুলছে ওরা ! তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো বৈঠকে সরাসরি নিজে থেকে তিনি একটা কড়া বার্তা দিয়ে দার্জিলিং-এর মানুষের উন্নয়ন,কর্মসংস্থান এর ব্যবস্থা করতে চেয়েছেন । দুর্নীতির খতিয়ান দেখতে চান ।
সেই ইতিহাসের দার্জিলিং, সেই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর মেঘের রাজ্য,সেই রোমান্টিসিজমকে মমতা ব্যানার্জি ফিরিয়ে আনতে চাইছেন রাজনৈতিক বাস্তবতার কষ্টিপাথরে।