বুড়োশিব দাশগুপ্ত

গত বছর শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করেছিল। এই সপ্তাহের শুরুতে তা আরও শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছয় যখন হাসিনাকে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা আন্দোলনের অংশীদার এক যুবনেতা হাদিকে হত্যা করা হয়। সন্দেহের তীর বাংলাদেশের ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (র) এবং তাদের সহযোগীদের দিকে। হিন্দুদের ওপর অগ্নিসংযোগ, গণপিটুনি ও হত্যার ঘটনা ঘটে এবং ভারত সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে কঠোর হুঁশিয়ারি দেয়।

বাংলাদেশে নতুন করে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার প্রতিক্রিয়ায় ভারতের নানা শহরে বিক্ষোভ দেখা দেয় এবং এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসকে অনুরোধ করে যাতে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের মিশনগুলি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। শুধু বাংলাদেশের ভালর জন্যই নয়, বরং সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার জন্যেই দেশটিতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসা অপরিহার্য, যেখানে চিন ও আমেরিকার মতো শক্তিশালী দেশগুলি একসঙ্গে কাজ করছে। হাসিনা তাঁর কথিত ‘এজেন্ট’ মহম্মদ ইউনূসের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য প্রকাশ্যে আমেরিকাকে দায়ী করেছেন। ভারতের জন্য, বাংলাদেশের অস্থিরতা কেবল তার প্রতিবেশীর সঙ্গে বার্ষিক ১২ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যকেই প্রভাবিত করে না, বরং তার অভ্যন্তরীণ শান্তিকেও বিঘ্নিত করে। ভারত ইতিমধ্যেই হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের দোরগোড়া. রয়েছে এবং বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি আগুনে ঘি ঢালছে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভারতের অবদান বেশিরভাগ মানুষই ভুলে গিয়েছেন। পাকিস্তান হয়তো বাংলাদেশ থেকে পিছু হটেছে, কিন্তু তাদের অপমান তারা কখনওই ভুলতে পারবে না এবং তাদের অনুগামীরাও দেশ ছেড়ে যায়নি। শেখ মুজিবের কন্যা হাসিনা তাঁর পিতার হত্যাকাণ্ডের পর থেকে ভারতের পরোক্ষ সাহায্যে শাসন করে আসছেন। দেশের পিছিয়ে পড়া অর্থনীতিকে হাসিনা মূলত বস্ত্রশিল্পের উন্নতির মাধ্যমে মোকাবিলা করেছিলেন। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা দেশটিকে আবারও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব যুবসমাজকে প্রভাবিত করেছে এবং কোনও ভাবে ভারতের উপর হাসিনার নির্ভরতা সন্দেহের জন্ম দেয়। এতে ইন্ধন জোগায় পাকিস্তানপন্থীরা, যারা সাধারণত ‘রাজাকার’ নামে পরিচিত ছিল। পাকিস্তান চিনের সমর্থনে বাংলাদেশে অর্থাৎ ‘পূর্ব পাকিস্তানে’ আবার ক্ষমতায় ফিরতে চায়। প্রথম পদক্ষেপ ছিল হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা, যাকে তারা ‘স্বৈরাচারী’ বলে বর্ণনা করেছিল। তারা যুব সমাজের অসন্তোষকে কাজে লাগায়। বাংলাদেশের আদালত গত বছরের আন্দোলনের সময় যুবক হত্যার জন্য হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় এবং ভারত, যেখানে তিনি এখন বসবাস করছেন, তাকে হস্তান্তর করার জন্য অনুরোধ করে। যা ভারত স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাখ্যান করেছে। এতেই ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়।

পাকিস্তানের প্ররোচনায় গঠিত ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার প্রায়শই উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘সেভেন সিস্টারস’ রাজ্যগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি ‘বৃহত্তর’ বাংলাদেশের কথা বলে। ফিল্ড মার্শাল মুনিমও এই ধরনের মন্তব্য করেন। পশ্চিমবঙ্গের ‘চিকেন নেক’ এলাকাটিও এই সংযুক্তির জন্য একটি আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। ভারত দ্রুত শিলিগুড়ির কাছে এই অঞ্চলে তার সশস্ত্র বাহিনীকে শক্তিশালী করে। সুতরাং, বাংলাদেশে বাড়তে থাকা এই সমস্যা ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সংঘাতকে ২০২৬ সালের শুরুতে ঘোষিত নির্বাচনকে ভণ্ডুল করার একটি প্রচেষ্টা হিসেবেও ব্যাখ্যা করছেন। হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইতিমধ্যেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যা থেকে বোঝা যায় যে ফলাফল একতরফা হবে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ এবং তাঁর ছেলে তারেক রহমান এই সপ্তাহে বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামি ইসলামপন্থী এবং পাকিস্তানপন্থী দল। তাদের ক্ষমতায় আসা মানে ভারতবিরোধী অবস্থান শক্তিশালী হওয়া এবং পাকিস্তানের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়া।

বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। যদি আদৌ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়। হাদির হত্যাকাণ্ডের তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদি বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ এতে ভারতের ‘হাত’ রয়েছে প্রমাণের চেষ্টা করে, তাহলে সম্পর্ক আরও খারাপ হবে।