কৃশানু মজুমদার: দিনের বেলায় রাতের অন্ধকার দেখেছিলেন। কাছের বন্ধুদের দূরে সরে যাওয়াও দেখতে হয়েছিল। আইএসএলের ক্লাব পাঞ্জাব এফসি-র ভারতীয় সহকারী কোচ শঙ্করলাল চক্রবর্তী নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই আশ্বস্ত করছেন বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত ইস্টবেঙ্গল-মহামেডান সমর্থকদের। দুই প্রধানের সমর্থকদের জন্য তাঁর বার্তা, ''মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে।''
আইএসএলে টানা ছ' ম্যাচ হেরে লাল-হলুদ এখন পয়েন্ট তালিকার তলানিতে। ধুঁকছে লেসলি ক্লডিয়াস সরণীর ক্লাব। রেড রোডের ধারের সাদা-কালো জার্সিধারীরা এখন ১১ নম্বরে। দুঃসময় সঙ্গী তাদেরও। বহু যুদ্ধের সৈনিক বাঙালি শঙ্কর বলছেন, ''ইস্টবেঙ্গল-মহামেডান স্পোর্টিং লিজেন্ড ক্লাব। কত ঐতিহ্য ওদের। ওদের খারাপ অবস্থায় থাকতে দেখলে খারাপ লাগে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওরা ঠিক কামব্যাক করবে।''
শঙ্করলাল চক্রবর্তী জীবনের উত্থান-পতন দুই দেখে ফেলেছেন। তিনিও তো জীবনযুদ্ধে একপ্রকার কামব্যাকই করেছেন। অন্ধকার সরিয়ে আলোর দেখা পেয়েছেন। দারুণ সম্ভাবনাময় এক ফুটবল কেরিয়ার ছিল। চির আবেগের বড় ম্যাচে নাইজেরিয়ান চিমা ওকোরির সঙ্গে সংঘর্ষে পা ভাঙে। বহু পরিশ্রম, বহু ঘাম ঝরানোর পরেও আগের সেই ছন্দ আর ফিরে পাননি ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন ফুটবলার।
কবি সুকান্তর লাইনগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করলে মোটেও বেমানান হবে না তাঁর জন্য। ফুটবল তোমায় দিলাম আজকে ছুটি। আঁধার নেমে আসে তাঁর চারপাশে। গ্রাস করে হতাশা। চেনা পৃথিবীটাও ক্রমশ ছোট হতে থাকে।
কথায় বলে, বিহাইন্ড এভরি সাকসেসফুল ম্যান দেয়ার স্ট্যান্ডস এ উওম্যান। স্ত্রী পৌলমীর প্রেরণায় শঙ্করলাল কোচিংয়ে আসেন। তার পর এক স্টেশন অতিক্রম করে আরেক স্টেশনের দিকে ক্রমশ এগিয়ে চলেছেন তিনি। সঞ্জয় সেনের সঙ্গে একযোগে কাজ করে মোহনবাগানকে আই লিগ এনে দিয়েছেন দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে। একক ভাবে সবুজ-মেরুনের রিমোট কন্ট্রোল হাতে নিয়েছেন। ঘোর দুঃসময়ে মহামেডান স্পোর্টিংয়েরও দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ভবানীপুর, সুদেভা, বেঙ্গালুরু ইউনাইটেড হয়ে পাঞ্জাব এফসি-ই এখন বাঙালি কোচের ঠিকানা।
তিনি যাই ধরছেন, তাতেই এখন সোনা ফলাচ্ছেন। মনে করিয়ে দিচ্ছেন সেই মিডাস রাজার কথা। ডেভেলপমেন্ট লিগে তাঁর মগজাস্ত্রের কাছে থমকে গিয়েছে ইস্টবেঙ্গল। ডেভেলপমেন্ট লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ব্রিটেনের মাটিতেও প্রতিফলিত হয়েছে শঙ্করের কোচিং দক্ষতা। এভার্টনকে মাটি ধরিয়েছে তাঁর পাঞ্জাব এফসি। পরে অ্যাস্টন ভিলাকেও হারিয়েছে।
পাঞ্জাব থেকে আজকাল ডিজিটালকে শঙ্করলাল বলছেন, ''সাফল্য আমাদের গোটা দলের। আমাদের গ্রাসরুট এবং ইউথ সিস্টেমের সুপরিকল্পনার সুফল আমরা পেয়েছি এবং পাচ্ছি। আমাদের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর নিকোলাসের অধীনে দুর্দান্ত কাজ হচ্ছে। একটা কথা বলতেই হবে। আমাদের ইউথ সিস্টেমের যে ছেলেগুলো খেলেছে তারা অত্যন্ত প্রতিভাবাসম্পন্ন। ফুটবলের ট্যাকটিক্যাল জ্ঞানও খুব ভাল। অপরাজিত থেকে আমরা ডেভেলপমেন্ট লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। ১৭টা ম্যাচে কেবল তিনটে গোল খেয়েছিলাম। এর থেকেই বোঝা যায় দলের শক্তি, ছেলেদের হার না মানা মনোভাব।''
কিন্তু বিলেতে যে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের প্রতিযোগিতা ছিল। ইংল্যান্ডের শক্তিশালী দলগুলোর মোকাবিলা করতে হয়েছিল। শঙ্করলাল বলছেন, ''একটা জিনিস মাথায় নিয়ে খেলতে গিয়েছিলাম। আমরা কেবল পাঞ্জাবের প্রতিনিধি নই। দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়েছি। ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে এক মাসের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। আমি স্থির করেছিলাম শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলব না। আগে জলহাওয়ার সঙ্গে পরিচিত হব, তার পরে যে স্টাইলে আমরা খেলি, সেই স্টাইলেই ফুটবল খেলব। পরিকল্পনার সুফল পাই আমরা। একেবারে গোড়া থেকেই যদি ঝাঁপাতাম, তাহলে ভারতের অন্য দুটো ক্লাবের মতো হতশ্রী রেজাল্ট হত আমাদের।''
তিনি অন্তর্মুখী স্বভাবের। চূড়ান্ত টেনশনের ম্যাচেও শান্ত থাকেন। আনন্দে গা ভাসিয়ে দেন না। আবার হারেও 'গেল গেল' রব তোলেন না। নিজের মূল্যায়ন করতে বসে নিজেকে শূন্য দেন। ফুটবলার জীবনে ইতালির বিখ্যাত ডিফেন্ডার ফ্র্যাঙ্কো বারেসিকে অনুসরণ করতেন। ডাচ কিংবদন্তি জোহান ক্রুয়েফ এবং পেপ গুয়ার্দিওলার কোচিং স্টাইল তাঁকে আকর্ষণ করে। এই বঙ্গদেশে সুভাষ ভৌমিক তাঁর মনপ্রাণ জুড়ে রয়েছেন। বিচক্ষণ কোচ বলেন, ''সাফল্য একদিনে আসে না। বহু পরিশ্রম, বহু পরিকল্পনার ফসল সাফল্য। আমরা ডেভেলপমেন্ট লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে সবাই মিলে আলোচনায় বসেছিলাম। আমি স্বপ্ন দেখতাম বিদেশের মাটিতে কোচিং করিয়ে জিতব। দশ জন মিলে ডিফেন্স আমি করব না। নেক্সট জেন কাপে যাওয়ার আগে ছেলেদের ময়দান সিনেমাটা দেখিয়েছিলাম। ওদের বোঝাই, দিকপাল সব ফুটবলাররা দেশকে সম্মান এনে দিয়েছিলেন। টেকনিক্যাল-ট্যাকটিক্যাল জ্ঞানের পাশাপাশি এগুলোও কিন্তু খেলোয়াড়দের মোটিভেট করে।''
চলতি আইএসএলে পাঞ্জাব এফসি এই মুহূর্তে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। ইস্টবেঙ্গল, মহামেডান স্পোর্টিংয়েরও আগে। ইতিমধ্যেই কোচ বদল করে ফেলেছে ইস্টবেঙ্গল। সাফল্য তবুও ধরা দিচ্ছে না। মহামেডান স্পোর্টিংও প্রথমবার আইএসএল খেলতে নেমে হাজার ওয়াটের আলো ছড়াতে পারছে না। অন্যদিকে পাঞ্জাব এবার দারুণ শুরু করেছে। কীভাবে সম্ভব হল? বাস্তববাদী শঙ্করলাল বলছেন, ''মহামেডানের এটাই আইএসএলে প্রথম বছর। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে ওদের। প্রথম বছরে আমরাও অনেক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলাম। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছি। এবছর আগের থেকে ভাল হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। একটা-দুটো ম্যাচ হেরে গেলে, সব শেষ হয়ে গেল মনে করার কারণ নেই। ভুল শুধরে নেওয়া, কোথায় ভুল হচ্ছে সেটা খতিয়ে দেখা উচিত। আমাদের সাপোর্টিং টিম, ভিডিও অ্যানালিস্টরা একযোগে কাজ করছে। নিকোলাসের নেতৃত্বে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করছি। এবার শুরুটা ভাল করেছি। এই ধারা বজায় রাখতে হবে। পাঞ্জাব এফসি-র জেলায় জেলায় নিজস্ব স্কুল আছে। অনেক কাজ করছে। অতীতে পাঞ্জাব দুর্দান্ত সব প্লেয়ার দিয়েছে দেশকে। আমি আশাবাদী আগামিদিনে ভারতের ফুটবল শাসন করবে পাঞ্জাব।''
ডায়রি লেখা অভ্যাস শঙ্করলালের। সুখ-দুঃখের স্মৃতিরা জীবন্ত হয়ে রয়েছে তাঁর ডায়রিতে। ইদানীং ভারতীয় ফুটবলে বাঙালি ফুটবলার-কোচের সংখ্যা কমছে। আইএসএলের প্রথম ডার্বির দিন যুবভারতীর কংক্রিটের গ্যালারিতে দেখা গিয়েছিল ব্যানার, ''গ্যালারি আজ বলছে ভাই, ডার্বিতে বাঙালি ফুটবলার চাই।'' নিন্দুকেরা বলে থাকেন, ''বাঙালি বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারে না।''
শঙ্করলাল এখানেই ব্যতিক্রমী। বাংলার ফুটবলের পতাকাবাহক হতেই পারেন তিনি। চেনা শহরে কোচিং করাতে ইচ্ছা করে না? ফিরতে ইচ্ছা করে না? তিনি বলছেন, ''আমি ঘরকুণো স্বভাবের। কলকাতায় থাকলে ভালই হয়। ফ্যামিলিকেও মিস করব না তাহলে। কিন্তু কাজের মধ্যে তো থাকতে হবে। একগুঁয়েমি করে কলকাতা ছাড়া অন্য কোথাও যাব না, এই মনোভাব আমার আর নেই। আমি বেশ বুঝতে পেরেছি, অভিমান, কান্নাকাটির জায়গা নেই। তাহলে পিছিয়ে পড়তে হবে। বাস্তবিক জীবনে আমার কান্না, অভিমানের গুরুত্বই নেই। আমাকে কাজ করে যেতে হবে। উন্নতি করতে হবে। আইএসএলে একক ভাবে কোনও ক্লাবকে কোচিং করানোর স্বপ্ন দেখি। জাতীয় দলের হেড কোচ হওয়ার স্বপ্ন দেখি।''
প্রথম বাঙালি কোচ হিসেবে প্রো লাইসেন্স ডিগ্রি পেয়েছেন। এদিকে জাতীয় দলে পালাবদল ঘটেছে। তবুও কি শঙ্করলালের কথা ভাববেন না ফেডারেশন কর্তারা? কঠিন প্রশ্ন শুনে তিনি বলছেন, ''আমার পক্ষে এটা বলা সম্ভব নয়, এআইএফএফ-এর টেকনিক্যাল কমিটিতে বিচক্ষণ মানুষরা রয়েছেন। ফেডারেশন প্রেসিডেন্টও নামকরা প্রাক্তন ফুটবলার। ওঁরা কাকে নির্বাচিত করবেন, সেটা ওদের ব্যাপার। আমাদের কাজ করে যেতে হবে। ওঁরা যদি আমাদের কথা ভাবেন, আমাদের সম্মান দেন, তাহলে নিশ্চয়ই যাব।''
এক স্বপ্ন ভেঙে গেলে আরেকটা স্বপ্নও গড়া যায়। দরকার নিজের উপরে বিশ্বাস। আর দরকার স্বপ্নকে ধাওয়া করে যাওয়া। বরানগরবাসী কোচ তাই দেখিয়ে দিয়েছেন গোটা দেশকে। ধুঁকতে থাকা, ব্যর্থতার আবর্তে জড়িয়ে পড়া জীবন সাহস পেতে পারে বাঙালি শঙ্করলাল চক্রবর্তীকে দেখে।
