কৃশানু মজুমদার: অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গের ছবি পাঠিয়ে তিনি বলছেন, ''ব্রাদার, আমি অ্যাম স্টিল ফিট।'' ৬ বছরের শিশুপুত্র ওমরের ফ্রি কিক থেকে গোল করার ভিডিও দেখার অনুরোধ জানিয়ে ভিনদেশি সাংবাদিককে উত্তেজিত ভাবে বলছেন, ''মাত্র ৬ বছর বয়স। কীরকম ফ্রি কিক থেকে গোল করল দেখলেন?''
গর্বিত বাবা বলে চলেন, ''আমার দুই ছেলে। ওমর আর আদম। ওমরের বয়স ৬। আদমের চার। আমি ওদের ট্রেনিং দিই। ভাল ফুটবল খেলে ওরা।'' একসময়ের কোচ সুভাষ ভৌমিকের প্রয়াণ সংবাদ তাঁর জানা। স্মৃতিরোমন্থন করে বলছিলেন, ''আমার কোচ। ওঁর সঙ্গে আমার কথা হত। যোগাযোগ ছিল। আমি জানি কোচ আর নেই। ওঁর ছেলের সঙ্গে কথা হয় আমার।''
এত পর্যন্ত পড়ার পরে অনেকেই কৌতূহলী হয়ে উঠতে পারেন। প্রশ্ন জাগতে পারে কে তিনি? তিনি আক্রম মোঘরাবি। লেবানন থেকে বন্ধু বেলালের সঙ্গে খেলতে এসেছিলেন এই দেশে। সুভাষ ভৌমিকের হাত ধরে চার্চিল ব্রাদার্স সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। সেই দলের সদস্য ছিলেন বেলাল ও আক্রম। পরে আক্রমের পিঠে উঠেছিল মোহনবাগানের সবুজ-মেরুন জার্সি। ১৩ নম্বর জার্সি পরে খেলেছিলেন বাঙালির চিরআবেগের ডার্বি। বড় ম্যাচের ভিডিও পাঠিয়ে লেবাননের তারকা ফুটবলার বলছেন, ''যুবভারতীতে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ। দিপান্দা ডিকা দুটো গোল করেছিল। এই গোলটা আমার অ্যাসিস্ট থেকে।''
ডার্বিতে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে খেলেছেন আক্রম। শুক্রবার ভুটানে তাঁর দেশের আল নেজমে ক্লাবকে মাটি ধরিয়ে অস্কার ব্রুজোঁর ইস্টবেঙ্গল পৌঁছে গিয়েছে এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে। কেমন লাগল লাল-হলুদকে? একসময়ের প্রতিপক্ষের খেলা দেখে একপ্রকার মোহিত আক্রম। ফুটছেন তিনি। লেসলি ক্লডিয়াস সরণির ক্লাবের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলছেন, ''ইস্টবেঙ্গলকে দেখে বেশ ভাল লাগল। খুব ভাল খেলেছে ওরা। ভারতের ফুটবল কিন্তু আগের থেকেও উন্নত হয়েছে।''
আক্রম ফিরে যাচ্ছেন তাঁর ফেলে আসা সময়ে। চার্চিল ব্রাদার্সের জার্সি গায়ে রামধনুর মতো বাঁকানো শটে বিপক্ষের জাল কাঁপাচ্ছেন তিনি। এখনকার স্প্যানিশ তারকা লামিনে ইয়ামালের কাছ থেকে ওরকম বাঁ পায়ের বাঁক খাওয়ানো শটে গোল দেখতে অভ্যস্থ এখনকার বিশ্ব। আক্রম তাঁর গোল করার ভিডিও পাঠিয়ে বলছেন, ''২০১৩ সালে চার্চিলের জার্সি পরে এই গোলটা করেছিলাম। বেস্ট গোল হয়েছিল ইন্ডিয়ায়।''
তাঁর বন্ধু বেলাল চার্চিলের রক্ষণ নিশ্ছিদ্র করেছিলেন। তিনি এখন অস্ট্রেলিয়ায়। আক্রম রয়ে গিয়েছেন লেবাননে। বারুদের গন্ধ সেখানকার আকাশবাতাসে। ইজরায়েলের আক্রমণে অশান্ত মধ্যপ্রাচ্য। যুদ্ধের আবহে লেবাননের স্থানীয় ফুটবল লিগ স্থগিত। ভয়ভীতির পরিবেশ। আক্রম বলছেন, ''উই আর ইন আ স্টেট অফ ওয়ার ব্রাদার। এখানকার ফুটবল লিগ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাড়ির বাইরে যেতে ভয় করে। কিন্তু আল নেজমেকে কৃতিত্ব দিতেই হয়। দেশের এই পরিস্থিতিতে ফুটবলাররা মাথা ঠান্ডা রেখে, মন শক্ত করে লেবাননের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছে। চাপ ছিল, দুর্ভাবনা-দুঃশ্চিন্তা ছিল। তা নিয়েও ওরা কিন্তু বিদেশের মাটিতে সাহসী ফুটবল খেলে গিয়েছে। তবে গতকাল ইস্টবেঙ্গল ওদের থেকে অনেক ভাল খেলেছে।''
ত্রিপোলি ক্লাবের হয়ে এখন খেলছেন আক্রম। মোহনবাগানের প্রাক্তন সতীর্থদের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হয়। ছোটবেলা থেকে ১৩ নম্বর প্রিয়। সেই কারণে সবুজ-মেরুনে তাঁর পিঠে উঠেছিল ১৩ নম্বর জার্সি। নিয়ম করে তিনি আইএসএল দেখেন। আবার তুরস্কের পাসপোর্টও তৈরি করে রেখেছেন। ভবিষ্যতে হয়তো লেবানন ছেড়ে তুরস্কে গিয়ে পাকাপাকি ভাবে থাকবেন। যুদ্ধ, যুদ্ধ আর যুদ্ধ কী কারওর ভাল লাগে!
আক্রম এক নিঃশ্বাসে বলে চলেন, ''আল নেজমে ক্লাবের সবাইকে আমি চিনি। আমি নিজেও এই ক্লাবের প্রাক্তন ফুটবলার। কোচ আব্বাস আহমেদ আমার বন্ধু। একসঙ্গে ১৮ বছর খেলেছি আল নেজমে ক্লাবের হয়ে। কিন্তু যুদ্ধে দলের প্রত্যেকের অবস্থা খুব খারাপ হয়েছিল। ফুটবলারদের বাড়িঘর ভেঙে গিয়েছিল। পরিবারের লোকজন প্রাণ বাঁচানোর জন্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে ভাল করে কি ফুটবল খেলা যায়? তবে আল নেজমে দলকে প্রশংসা করতেই হবে। ওদের চারিত্রিক দৃঢ়তা দেখে আমি খুশি। দেশের হয়ে ওরা লড়তে গিয়েছিল বিদেশের মাটিতে। ভাগ্য অবশ্য শেষ পর্যন্ত ওদের সহায় হয়নি। ফুটবলে আপনি সবসময়ে জিতবেন না। ওদের ধন্যবাদ জানাই।''
আক্রম ভোলেননি কিছুই। ভারতে খেলে যাওয়ার স্মৃতিগুলো এখনও তাঁর হৃদয়ে জ্বলে নেভে জ্বলে। টাইমমেশিনের সাহায্য না নিয়ে তিনি ফিরে যাচ্ছেন সেই ২০১৮ সালের ডার্বিতে। খেলা শুরুর বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গেই দিপান্দা ডিকার গোলে এগিয়ে যায় মোহনবাগান। ৩৫ মিনিটে ফের ডিকাই ম্যাচের নিষ্পত্তি করে দেন। আক্রম বলে চলেন, ''ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ওই ডার্বিটা আমার মনে ছাপ ফেলে গিয়েছে। স্মৃতি থেকে মুছবে না কোনওদিন। আমি এই লেবানন থেকে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের খোঁজখবর রাখি। ভারতের ফুটবলের উন্নতি হচ্ছে একটু একটু করে। এটা দেখে ভাল লাগছে। ভারতের দল বিদেশি দলের বিরুদ্ধেও সাহসী ফুটবল খেলছে। লড়াই করছে। ভারতের ক্লাব ফুটবলে খেলেছি। সেই দেশের ক্লাবের লড়াই দেখতে বেশ ভাল লাগে।''
একরাশ আশঙ্কা, ভয় বুকে নিয়ে এখন দিন কাটাচ্ছেন লেবাননের মানুষজন। আক্রম মোঘরাবিও এর ব্যতিক্রম নন। দেশের পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে, কেউ জানেন না। যুদ্ধের আবহে কলকাতা, ভারতের ক্লাবে খেলে যাওয়ার স্মৃতি দখিনা বাতাস বয়ে আনছে চার্চিল-মোহনবাগানের প্রাক্তন ফুটবলারের মনে। এই কঠিন সময়ে যা আক্রমকে দিচ্ছে দু-দণ্ডের শান্তি।
