কৃশানু মজুমদার: কোনওদিন ভাবিনি নাইট ডিউটি করে সংসার চালাতে হবে। একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে চলেন নাড়ুগোপাল হাইত। মনে আছে তাঁকে? একসময়ে তিনি মহমেডান স্পোর্টিংয়ের সেনানী ছিলেন। আবার ডুরান্ড চ্যাম্পিয়ন চিরাগ ইউনাইটেডের সদস্যও তিনি। চিরাগের রাজধানী জয় এখনও তাঁকে করে তোলে আবেগপ্রবণ।
সেই নাড়ুগোপাল হাইত গত পাঁচ বছর ধরে সিভিক ভলান্টিয়ার। পেশাদার ফুটবল থেকে সরে গিয়েছেন বেশ কয়েকবছর হল। কিন্তু প্রথম প্রেম কি ভুলতে পারেন কেউ? নাড়ুগোপাল হাইতও পারেননি ভুলতে।
ফুটবল এখনও তাঁর রক্তের গতি বাড়িয়ে দেয়। সারা রাত ধরে ডিউটি করার পরেও ফুটবল তাঁকে টেনে নিয়ে যায় সবুজ ঘাসের মাঠে। তাঁর মোবাইলের কলার টিউনে ঝঙ্কার তোলে, ''সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল...।'' ফুটবল তাঁর রক্তে, তাঁর শয়নে, স্বপনে এবং জাগরনে।
আরও পড়ুন: একাধিক সুযোগ নষ্ট, পিয়ারলেসের কাছে হেরেও লিগ শীর্ষেই থাকল ইউকেএসসি
পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্য এখন নাড়ুগোপাল। তাঁর অধীনেই রয়েছেন প্রায় ৭৫ জনের কাছাকাছি সিভিক ভলান্টিয়ার। তাঁদের মধ্যে জনা চল্লিশের রোস্টার তৈরির কাজ করতে হয় প্রাক্তন ফুটবলারকে।

এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময়ে একাধিকবার স্থানীয় থানা থেকে ফোন এসেছে হাড়োয়ার নাড়ুগোপালের কাছে। প্রাক্তন ফুটবলার বলছিলেন, ''আমি মনে করি, একজন খেলোয়াড় সমাজের যে কোনও সমস্যায় ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন। সমাজের সঙ্গে মিশে যাওয়ার শিক্ষা খেলার মাঠই দেয়।''
লড়াকু জীবনের গল্প বলে চলেন প্রাক্তন ফুটবলার, ''অনেক পরে ফুটবল শুরু করেছি। বাবা নিরুদ্দেশ সেই ছোটবেলা থেকেই। অনেক ইতিহাস রয়েছে। সেগুলো আর নাই-বা বললাম। ফুটবল আমাকে এখনও টানে। খেলার সময়ের মুহূর্তগুলো আমার চোখে ভাসে। নাইট ডিউটি করে সংসার চালাব একদিন, তা কোনওদিন কল্পনাও করিনি। তবে সব কাজই কাজ। সব কাজকেই শ্রদ্ধা করতে হয়।''

মহামেডান স্পোর্টিংয়ে খেলেছিলেন একবছর। খেলেছেন ইস্ট-মোহনের বিরুদ্ধে। তার আগে চিরাগ ইউনাইটেডের জার্সিতে ঘাম ঝরিয়েছেন। সাদার্ন সমিতিতে খেলার সময়ে ভয়ঙ্কর পথ দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন। যাবতীয় স্বপ্নের সলিল সমাধি তখনই। ফুটবলার জীবনে বসে যায় পূর্ণচ্ছেদ। শুরু করেন কোচিং।
একদিকে সিভিক ভলান্টিয়ারের কাজ, অন্যদিকে কোচিং জীবন, দুই সমান তালে চালিয়ে যাচ্ছেন নাড়ুগোপাল। তাঁর একসময়ের সতীর্থ অর্ণব মণ্ডল বলছেন, ''খুব ভাল লেফট ব্যাক ছিল।'' আরেক সতীর্থ প্রাক্তন গোলকিপার অভিজিৎ মণ্ডল বলছেন, ''খুব ভাল ছেলে। দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল না। একটা প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে গিয়ে দেখা হয়। কথাবার্তা হত। শুনেছি ও সিভিক ভলান্টিয়ারের কাজ করে। আই লিগ খেলা একজন ফুটবলারের চাকরি পদমর্যাদার দিক থেকে আরেকটু ভাল হতে পারত।''
ইস্টবেঙ্গলের রিমোট কন্ট্রোল হাতে ট্রেভর জেমস মর্গ্যানের অশ্বমেধের ঘোড়া তখন ছুটছিল দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। সেই ঘোড়াই থেমে যায় দিল্লিতে। ডুরান্ড কাপের সেমিফাইনালে চিরাগ ইউনাইটেডের কাছে হার মানতে হয় লাল-হলুদকে। ফাইনালে জেসিটিকে হারিয়ে ডুরান্ড কাপ কলকাতায় আনে সুব্রত ভট্টাচার্যের চিরাগ। সেই দলের লেফট ব্যাক ছিলেন নাড়ুগোপাল। স্মৃতির পাতা উলটে তিনি বলছেন, ''ডুরান্ড কাপ এখন কলকাতায় হয়। সেই সময়ে তো দিল্লিতে হত। আমরা ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছিলাম। ফাইনালে জেসিটি-কে হারিয়ে ট্রফি জিতি। আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত।''

নস্ট্যালজিক নাড়ুগোপাল পরক্ষণেই ঘোর বাস্তববাদী। তিনি বলছেন, ''মাসোহারা যা পাই, তাতে নুন ভাত জুটে যায় কোনওরকমে। আমার মেয়ে এখন পড়াশোনা করছে। পড়াশোনার খরচ রয়েছে, শরীর থাকলে অসুখ-বিসুখ হবেই, সেই দিকে নজর দিতে হয়। আমার পা বাস্তবের মাটিতে। আমি সবটাই এখন মেনে নিয়েছি।''
নিশুত রাতে রাস্তায় প্রহরারত এক সিভিক ভলান্টিয়ার। অবাক রাতের তারারা কেবল তাঁর সঙ্গী। দু'চোখে উঁকি দিয়ে যায় সুখ-দুঃখের মুহূর্তরা। কখনও তিনি কাঁদেন, কখনও হাসেন। অস্ফুটে বলে যান, ''এই তো জীবন কালীদা...।''
