কৃশানু মজুমদার: প্রথম ওয়ানডে-তে তিনি রান আউট। বাংলাদেশের তাপস বৈশ্যর থ্রো থেকে বেল ফেলে দেন উইকেট কিপার খালেদ মাসুদ।
কেরিয়ারের শেষ ওয়ানডে-তেও রান আউট। মার্টিন গাপ্তিলের থ্রো উইকেট ভেঙে দেয়। ক্রিজে আর পৌঁছনো হয়নি মহেন্দ্র সিং ধোনির।
জীবনের প্রথম ও শেষ ওয়ানডেতে আউট হওয়ার ধরণ মিলে গেল একই বিন্দুতে এসে। একেই বোধহয় বলে সমাপতন। সোমবার ছিল ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক ধোনির জন্মদিন।
আজ ৮ জুলাই। আরেক প্রাক্তন ভারত অধিনায়কের জন্মদিন। ৫৩ বছরে পা রাখলেন সৌরভ গাঙ্গুলি।
ধোনি ও মহারাজের 'সৌরভ' জড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশের প্রাক্তন পেসার তাপসের শরীরে। সাত বছর হয়ে গিয়েছে তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে মার্কিন মুলুকে। সেখানে কোচিং করছেন। তাঁর সঙ্গে চলছে ক্রিকেটও।
আজকাল ডট ইন-কে নিউ জার্সি থেকে তাপস বৈশ্য বললেন, ''মহেন্দ্র সিং ধোনি ও দাদাকে জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা। আমার মতো একজনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দু'জনের নাম। এটা দারুণ গর্বের একটা বিষয়।''

নিউ জার্সিতে তাঁর ক্রিকেট অ্যাকাডেমি। তিনি এখন পুরোদস্তুর কোচ। উঠতি ক্রিকেটারদের ক্রিকেটের অ-আ-ক-খ শিখিয়ে স্মৃতির সাগরে ডুব দিলেন তাপস। বললেন, ''ধোনির প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ ছিল চট্টগ্রামে। তখনও ধোনি আজকের ধোনি হয়নি। ইন্ডিয়া এ দলের হয়ে কেনিয়ায় দুরন্ত খেলে এসেছে। বিশাল বিশাল ছক্কা মারত। প্রথম ম্যাচে অবশ্য ধোনি খাতা খুলতে পারেনি। সাত নম্বরে ব্যাট করতে নামে। রফিকের বল মেরেই এক রানের জন্য দৌড়য়। নন স্ট্রাইক এন্ডে দাঁড়ানো মহম্মদ কাইফ রান নিতে আগ্রহী ছিল না। আমি বল পেয়েই থ্রো করে দিই। বাকি কাজটা করে খালেদ মাসুদ। ধোনির বায়োপিকেও কিন্তু ওই আউটটা ছিল। আমার এখন মনে হয় আমি ধোনির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছি। আমাকে কোনওদিন ভুলতে পারবে না এমএস।''
নিউ জার্সিতে তাপসের ক্রিকেট অ্যাকাডেমির শিক্ষার্থীদের মা-বাবারা বাংলাদেশের প্রাক্তন পেসারকে প্রশ্ন করেন, ''স্যর আপনি কি ধোনির বায়োপিকে অভিনয় করেছেন?'' তাপস দুষ্টুমি করে বলেছিলেন, তিনি অভিনয় করেছেন ভুবনজয়ী অধিনায়কের বায়োপিকে।
কলম্বোয় শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে তাঁর টেস্ট অভিষেক। বাংলাদেশের জার্সিতে ২১টি টেস্ট ও ৫৬টি ওয়ানডে খেলেছেন। টেস্টে ৩৬টি ও ওয়ানডে-তে ৫৯টি উইকেটের মালিক তিনি। এহেন তাপস বৈশ্য সৌরভকেও ফিরিয়েছেন সাজঘরে। স্মৃতিরোমন্থন করে বঙ্গতনয় বলছেন, ''দাদা লিজেন্ড। আসলে মাঠের বাইরে থেকে দেখতে একরকম লাগে। মাঠের ভিতরে আবার অন্যরকম। দাদা ব্যাট হাতে ক্রিজে নামা মানেই আমাদের খাটনি বাড়ত। দাদাকে আমি টেস্টে ৭১ রানে বোল্ড করেছি। ওয়ানডেতেও দাদাকে আউট করেছি। পিছন ফিরে তাকালে এখন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি।"'
একদিকে ধোনি, অন্যদিকে সৌরভ। দুই ভারত অধিনায়ককে আউট করার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তাপসের নাম। বিশ্বক্রিকেটের নামজাদা একেক জন ব্যাটারের সামনে মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে হাজির হয়েছেন বাংলাদেশি তারকা পেসার। পাকিস্তানের প্রাক্তন অধিনায়ক ইনজামাম উল হক, রিকি পন্টিং, যুবরাজ সিংদের প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠানোর নেপথ্য নায়ক তিনি। তাপস বলছেন, ''ব্রায়ান লারা, শচীন তেণ্ডুলকরের মতো লিজেন্ডদের আমি আউট করতে পারিনি। ভিভিএস লক্ষ্ণণকেও এলবিডব্লিুউ করেছিলাম টেস্টে। তবে অভিষেক ম্যাচের উইকেট সবসময়ে স্মরণীয় হয়। শ্রীলঙ্কার জিহান মোবারক আমার প্রথম টেস্ট উইকেট।''

সৌরভের প্রসঙ্গ উঠলে তিনি অনর্গল। শ্রদ্ধা ঝরে পড়ে কথায়। বলছিলেন, ''সৌরভ গাঙ্গুলি দুর্দান্ত অধিনায়ক। নতুন ভারত গড়েন দাদাই।''
শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে অপরাজিত ৫২ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তাপস। সেই ইনিংস এখনও বাংলাদেশের ক্রিকেটে চর্চিত হয়।
তিনি সরে যাওয়ার পর কতটা বদলেছে জাতীয় দল? বাংলাদেশ ক্রিকেটের 'পঞ্চপাণ্ডব' বলে পরিচিত পাঁচ তারকা- মাশরাফি মোর্তাজা, তামিম ইকবাল, মাহমুদুল্লাহ রিয়াধ, মুশফিকুর রহিম ও শাকিব আল হাসান তাঁদের সেরা সময় কাটিয়ে ধীরে ধীরে অস্তমিত। বাংলাদেশের ক্রিকেটেও কি তাই রক্তাল্পতা? তাপস ব্যাখ্যা করেন, ''এখন সিনিয়ররা সরে যাওয়ায় দলে অভিজ্ঞতা কম ঠিকই। তবে এখনকার ছেলেরা খুবই লড়াকু। এই দলে সুপারস্টার নেই। যে দল মাঠে নামে তারা টিম হয়ে উঠতে জানে। আমার আশা বাংলাদেশ আরও ভাল করবে।''

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের উপরে প্রচ্ছন্ন অভিমান ঝরে পড়ে তাপসের গলায়। তিনি বলেন, ''একটা সময়ে বোর্ডের কর্তারা মনে করতেন ওই পাঁচ জন ছাড়া আর কেউ ক্রিকেট খেলে না বাংলাদেশ দলে। একটা সময় যে পরিস্থিতি খারাপ হবে তা তো জানাই ছিল। তবে আমার আশা তরুণ খেলোয়াড়দের নিয়ে তৈরি বাংলাদেশ অনেক দূর এগোবে।''
আর ভারত? বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মার মতো তারকা ক্রিকেটার টি-টোয়েন্টি ও টেস্ট ফরম্যাট থেকে সরে গিয়েছেন। তাপস শেষ করতে দেন না। বলেন, ''ভারতের মতো দেশে প্রতিভার অভাব কোনওদিন হবে না। শচীন তেণ্ডুলকর সরে গেল, তার পরে বিরাট কোহলি হাল ধরল। শুভমান গিলের নেতৃত্বে ভারতীয় দল ইংল্যান্ডে কী দুর্দান্ত টেস্টটাই না খেলল। হেডিংলিতে তুল্যমূল্য লড়াই করেছে। আর এজবাস্টনে ইংল্যান্ডকে নক আউট করে দিয়েছে।''

সৌরভ-ধোনির নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা তাপসের উপলব্ধি, ক্রিকেট থেকে সরে যাওয়া মানেই সন্ন্যাস নয়। ধোনি-সৌরভরা ক্রিকেট ইতিহাসে চিরন্তন। তাঁদের আবেদন চিরকালের।
