আজকাল ওয়েবডেস্ক: ২০২০ সালের অতি সঙ্কটজনক ভোটের পর সবাই ভাবছিল ২০২৫ সালের বিহার বিধানসভা নির্বাচন হবে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। কিন্তু ফলাফল দেখাল সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ) ২৪৩ আসনের মধ্যে ২০২টি আসন জিতে বড় ধরনের জয় ছিনিয়ে নিয়েছে। বিজেপি একক বৃহত্তম দল হয়ে উঠেছে, আর জেডিইউ ২০ বছরের বেশি সময়ের শাসনকেও টেক্কা দিয়ে বিশাল প্রত্যাবর্তন করেছে।
বিজেপির বড় উত্থান
২০২০ সালে ৭৪টি আসন পাওয়া বিজেপি ২০২৫ সালে তার সংখ্যা বাড়িয়ে ৮৯ করেছে। এই প্রথমবার বিজেপি বিহারে একক বৃহত্তম দল। এবার বিজেপি ও জেডিইউ—দুই দলই ১০১টি করে আসনে লড়েছিল। দীর্ঘদিন জেডিইউ-র তুলনায় নিচে থাকা বিজেপি এই নির্বাচনে সংখ্যার দিক থেকে এগিয়ে যায়।
অন্যদিকে জেডিইউ, ২০২০ সালের মাত্র ৪৩ আসন থেকে উঠে এ বছর ৮৫ আসন জিতেছে। এনডিএ-র ছোট দলগুলোর মধ্যেও ভালো ফল করেছে এলজেপি (আরভি)—১৯টি আসন, এইচএএম—৫টি আসন এবং আরএলএম—৪টি আসন।
নীতিশ কুমার আবারও প্রমাণ করলেন তাঁর ভিত্তি মজবুত
বিহারের রাজনীতিতে নীতিশ কুমারের প্রভাব নিয়ে নানা জল্পনা ছিল। স্বাস্থ্যগত সমস্যা, জোট রাজনীতির চাপ, বিজেপির তাকে সামনে না রেখে প্রচার—এসব মিলিয়ে তাঁকে কোণঠাসা করার চেষ্টা হয়েছিল। এমনকি বিজেপি আগে থেকেই বলেছিল নির্বাচনের পর এমএলএরা মুখ্যমন্ত্রী ঠিক করবে।
তবুও নীতিশ কুমার আবারও নিজের শক্তি দেখালেন। তাঁর দল জেডিইউ-র আসন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। হারনৌট অঞ্চলে দলীয় কর্মীরা বলছেন, “নীতিশ কুমার ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।” এবারও তিনি ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য মুখ হিসেবে থেকে গেলেন।
RJD-র দশকের সবচেয়ে খারাপ ফলাফল
তেজস্বী যাদবকে মুখ্যমন্ত্রী মুখ করে লড়াইয়ে নামলেও আরজেডি ভেঙে পড়েছে। ২০২০ সালে ৭৫ আসন পেলেও এবার তারা মাত্র ২৫-এ থেমেছে—গত ১০ বছরের সবচেয়ে খারাপ ফল। বিজেপি পুরো প্রচারজুড়ে “জঙ্গলরাজ”-এর কথা তুলে ধরে ভোটারদের মনে পুরনো ভয় ফিরিয়ে আনে।
তেজস্বী যুবকদের চাকরি ও অভিবাসন নিয়ে প্রচার চালালেও বহু তরুণ মনে করেছেন প্রতিটি পরিবারকে সরকারি চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বাস্তবসম্মত নয়। টিকিট বণ্টনেও আরজেডি মূলত যাদব ভিত্তিভূমিকেই অগ্রাধিকার দেয়—৩৫% টিকিট যায় এই সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে।
কংগ্রেস আরও দুর্বল, ‘বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই’ ক্ষতি বাড়াল
২০২০ সালেই কংগ্রেস ছিল মহাগঠবন্ধনের দুর্বলতম অংশ। এবার ৬১টি আসন পেয়ে লড়েও কেবল ৬টিতে জয় পেয়েছে। গঠবন্ধনের ভেতর আসন-বণ্টন নিয়ে বড়সড় অশান্তি দেখা দেয়। ফলে ১১টি আসনে তথাকথিত “বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই” হয়—একই জোটের দল একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।
যে ৫টি আসনে কংগ্রেস ও আরজেডি মুখোমুখি হয়েছিল তার মধ্যে ৩টিতে জেডিইউ জেতে, বাকিগুলো বিজেপি ও এইচএএম দখল করে।
এসব মিলিয়ে বিরোধী জোটের বড় ক্ষতি হয়। কংগ্রেসের ভোটার অধিকার যাত্রা কিছুটা সমর্থন পেয়েছিল, কিন্তু এরপর প্রচারে দল খুব একটা সক্রিয় দেখা যায়নি।
ওয়াইসি ফ্যাক্টর ও মুসলিম নেতৃত্বের সংকট
সীমাঞ্চল অঞ্চলের চারটি জেলায় (পুর্নিয়া, কিশনগঞ্জ, আরারিয়া, কাটিহার) AIMIM আবারও শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করেছে।
২০২০ সালে AIMIM পাঁচটি আসনে জিতেছিল। যদিও পরে চারজন এমএলএ আরজেডিতে যোগ দেন, ২০২৫ সালে আবার সেই পাঁচ আসনেই AIMIM জয়লাভ করেছে।
ওয়াইসি প্রচারে অভিযোগ তোলেন—মহাগঠবন্ধন মল্লাহ সম্প্রদায়ের মুখপাত্র মুখেশ সহানিকে ডেপুটি সিএম মুখ ঘোষণা করলেও মুসলিমদের থেকে কাউকে সামনে আনে না। এই বক্তব্য তরুণ মুসলিম ভোটারদের মধ্যে প্রভাব ফেলেছে।
প্রশান্ত কিশোরের জন সুরাজের সম্পূর্ণ ভরাডুবি
প্রশান্ত কিশোরের নতুন দল জন সুরাজ পার্টি বিপুল প্রচার করলেও ফলাফল শূন্য। ২৩৮টি আসনে লড়েও একটিও আসন জিততে পারেনি তারা। গ্রামে গ্রামে পায়ে হেঁটে প্রচার করেও ভোটে তার প্রভাব পড়েনি। একসময় ধারণা ছিল তারা জোটের ভোটে কাটাছেঁড়া করবে, কিন্তু ভোটের বিচারে তাদের উপস্থিতি প্রায় অদৃশ্য।
২০২৫ সালের বিহার নির্বাচন দেখাল বিজেপি-জেডিইউ জোট এখনও রাজ্যে শক্তিশালী। নীতিশ কুমারের অবস্থান আরও একবার টিকে গেল। অন্যদিকে মহাগঠবন্ধনের ভিতরকার দ্বন্দ্ব, কংগ্রেসের দুর্বলতা এবং মুসলিম নেতৃত্ব নিয়ে সংকট—এইসব কারণে বিরোধী শিবির বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। সীমাঞ্চলে AIMIM-এর উত্থান এবং জন সুরাজের ব্যর্থতা—উভয়ই এই নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে রইল।
