গোপাল সাহা

কথিত আছে ‘কুসন্তান যদিও বা হয়, কুমাতা কদাপি নয়’। কিন্তু বর্তমান সমাজে তেমনটাই ক্রমাগত ঘটে চলেছে। মায়ের হাতেই নিধন হয়ে চলেছে সন্তান! আমরা সকলেই জানি এবং মানি যে পৃথিবীতে 'মা' ই একমাত্র শব্দ বা সম্পর্ক যার কোনও তুলনা হয় না। 'মা' ছাড়া পৃথিবীটা যেন সত্যিই অন্ধকার লাগে। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে বেড়ে ওঠা শুধু নয়, মায়ের হাত ধরে হাঁটতে শেখা, মায়ের আচলের ছাঁয়ায় বেড়ে ওঠা এবং জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে ক্ষণে মায়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আর সেই 'মা' যদি সন্তানের মৃত্যুর কারণ হয় কিংবা মায়ের বিরুদ্ধেই যদি সন্তানকে হত্যার অভিযোগ ওঠে বা প্রমাণিত হয়, সত্যি কি এর থেকে দুর্ভাগ্যের কিছু হতে পারে বলে মনে হয়? আর সাম্প্রতিক অতীত এবং বর্তমানে এ ধরনের ঘটনা শহর ছেড়ে রাজ্য তথা দেশ বা সারা বিশ্বে ঘটেই চলেছে। কিন্তু কেন?

যেখানে মা তার সন্তানকে ১০ মাস গর্ভে ধারণ করে সেই সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখান, সেই 'মা' কি ভাবে সন্তানকে অবলীলায় হত্যা করেন! বিশেষজ্ঞদের মতে এ এক অদ্ভূত ধরনের মানসিক বিকার বা রোগের পরিণতি। যার অধিকাংশই ঘটে সন্তানের বয়স একবছর না পেরোতেই (পরিসংখ্যান ৮টি প্রতি একলাখে)। স্কুলজীবনের প্রাক্কালে বা 'টডলার'দের মধ্যে (২.৫/প্রতি লক্ষ) ও স্কুলজীবনে (১.৫/প্রতি লক্ষ)  অর্থাৎ সন্তানের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অপেক্ষাকৃতভাবে কমতে থাকে শিশুসন্তানহত্যার ঘটনা।

পৌরাণিক আখ্যানে পাওয়া যায়, কুমারী গঙ্গা তাঁর সপ্তসন্তানকে জলে বিসর্জন দিয়েছিলেন। যে আঙ্গিকে এই ফিলিসাইডের তাৎক্ষণিক জটিল মনস্তত্ত্বের জন্ম নেয় সেগুলি আপাততুচ্ছ মনে হলেও জটিল মনস্তত্ত্ব রয়েছে এর পিছনে। 

১) সন্তানের ও নিজের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত দেখে, 'সন্তানের ভালোর জন্য' তাকে চিরতরে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়াও শ্রেয় বলে মনে হয়।

২) দাম্পত্য কলহজনিত কারণে সন্তানকে হত্যা করে জীবনসঙ্গীকে উচিত শিক্ষা দেওয়া (সিগময়েড ফ্রয়েড যাকে বর্ণনা করেছেন 'লস অফ লাভ অবজেক্ট') বলে।

এছাড়াও, বাবা-মা'য়ের মধ্যে অবসাদগ্রস্ততা, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, নেশাগ্রস্ততা, সন্দেহপ্রবণতা, দ্বিতীয় নারী-তৃতীয় পুরুষের প্রবেশ এই ফিলিসাইডের জন্ম দিতে পারে।

এই বিষয়ে পূর্বের ঘটনার কিছু স্মৃতিচারণ করা যাক-

সূচনা শেঠ, বেঙ্গালুরুর এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংস্থার কর্ণধার তাঁর চার বছরের পুত্রসন্তানকে গোয়াতে খুন করে ক্যাবে করে পালাতে গিয়ে পুলিশের জালে ধরা পড়েন ২০২৪-এর জানুয়ারিতে। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণেই এই 'ম্যাটারনাল ফিলিসাইড' বলে সংবাদমাধ্যমে বহুল প্রচারিত হয় ঘটনাটি। তরুণী শীনা বোড়া-কে খুনের জন্য গ্রেপ্তার করা হয় তাঁর মা 'মিডিয়া টাইকুন' ইন্দ্রাণী মুখার্জিকে।


PPD (Post partum Depression) এবং শিশুর প্রতি নির্যাতন:

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রসবের আগে ও প্রসবোত্তর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার (যেমন PPD) সঙ্গে শিশুর প্রতি শারীরিক আঘাত ও অবহেলার মতো নির্যাতনের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। একজন মায়ের বিষণ্ণতা তাঁর সন্তানের যত্ন নেওয়ার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে, যা অবহেলা বা এমনকি শিশুকে ক্ষতি করার চিন্তার জন্ম দিতে পারে।

নিম্নোক্ত কারণে PPD আক্রান্ত মায়েদের মধ্যে শিশু নির্যাতনের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তোলে-

১. অতীতের ট্রমা: শৈশবে নির্যাতনের শিকার হওয়া বা গার্হস্থ্য সহিংসতার অভিজ্ঞতা একজন মাকে PPD এবং তার ফলে শিশুর প্রতি সহিংস আচরণের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

২. মাদক বা নেশা জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার, 

3. দাম্পত্য কলহ  পরিবারে সহিংসতার ইতিহাস

4. গুরুতর মানসিক রোগের ইতিহাস

PPD বা 'প্রসবোত্তর বিষন্নতা' পারিবারিক ও সামাজিক কারণে আরও জটিল হয়। যেমন, অর্থনৈতিক সংকট, কন্যা সন্তানকে অপ্রত্যাশিত হিসেবে দেখার মানসিকতা, ধর্মীয় বা সামাজিক বাধ্যবাধকতা। তবে এক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, শিশুর জন্মের প্রথম চার সপ্তাহ থেকেই মায়েদের মধ্যে PPD স্ক্রিনিং ও তাৎক্ষণিক চিকিৎসা শুরু করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এর ফলে মা ও শিশু উভয়েই মানসিক ও শারীরিক জটিলতা থেকে রক্ষা পেতে পারে।

গবেষণায় দেখা গিয়েছে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলির প্রতি চার জন প্রসবোত্তর মায়ের মধ্যে একজন এবং প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হন। যেসব মায়েদের সন্তান জন্মদানের ইতিহাস ভালো নয়, সামাজিক সহায়তা কম, মানসিক রোগ বা শৈশবে সহিংসতার অভিজ্ঞতা রয়েছে, নিম্ন আয়ের এবং প্রসবকালীন বা নবজাতকের স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে তাদের মধ্যে PPD হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এছাড়াও, বিষণ্ণ মায়েদের শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি, অসুস্থতা এবং একচেটিয়াভাবে স্তন্যপান না করানোর প্রবণতা দেখা যায়। এই প্রভাবটি এমনকি স্ব-প্রতিবেদনমূলক স্কেল ও ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস উভয়ের মধ্যেই একই রকম পাওয়া গেছে।

এই বিষয়ে আজকাল ডট ইনের তরফ থেকে সরাসরি কথা বলা হয়েছিল শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ সংযুক্তা দে, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রঞ্জন ভট্টাচার্য এবং মহিলারোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তিস্তা ব্যানার্জি সঙ্গে। চিকিৎসক রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, "আনুমানিক ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে সন্তানকে হত্যা করে দেখা যায় মা'কেও আত্মঘাতী হতে, যাকে 'অ্যালট্রুইস্টিক সুইসাইড' বলা হয়। জীবনসঙ্গীর উপরে বিদ্বেষে সন্তানহত্যাকে বলা হয় 'রিভেঞ্জ ফিলিসাইড'।"

তিনি আরও বলেন, “হিউম্যান সাইকোলজি'তে বলে প্রত্যেক মানুষের মনেই সুপ্ত অপরাধী হওয়ার বাসনা থাকে। মৃত্যু ও হত্যার এই চোরাবালির মতো টান 'থ্যানাটোস' (গ্রীক মৃত্যুর দেবতা আামাদের যমরাজের মতো) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। 'কাপল থেরাপি' ও 'ফ্যামিলি থেরাপি'র মতো প্রয়োজন সঠিক সময়ে মানসিক রোগ নির্ণয় ও তার যথোপযুক্ত চিকিৎসা। নাহলে গভীর মানসিক অবসাদে নিমজ্জিত হতে যাওয়া আমাদের দেশে এই ঘটনা উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকবে।"

এই বিষয়ে চিকিৎসক সংযুক্তা দে বলেন, "গর্ভাবস্থায় মায়েদের মধ্যে শারীরিক নানা রকম পরিবর্তন আসে, মূলত হরমোনাল পরিবর্তন। সন্তান প্রসবের পরে প্রথমবার হওয়া মায়েরা অনেক ক্ষেত্রেই পারিবারিক সহযোগিতা না পাওয়া মানসিক বিষন্নতা গভীরভাবে তৈরি করে এবং বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে 'আঁতুড়ঘড়' পদ্ধতি ও এক প্রকার না থাকার মত। যার ফলে প্রসূতি মায়েদের এই বিষন্নতার প্রকোপ সন্তানের উপর গিয়ে পড়ে। বলাবাহুল্য, এ জায়গায় বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং পাশ্চাত্য অনুকরণ করতে গিয়ে সামাজিক ব্যাধি বা বিপদ ডেকে আনছেন মানুষ। এই PPD অর্থাৎ পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন, যাকে বাংলায় বলে 'প্রসবত্তর বিষন্নতা' পূর্বেও ছিল কিন্তু ততোধিক লক্ষ্য করা যায়নি তার কারণ দাইমা পদ্ধতি বা আঁতুড় ঘর পদ্ধতির কারণে সদ্যোজাত শিশুর ওপর আলাদা ভাবে নজর রাখা হতো যা, বর্তমানে হয় না। আর যে কারণে এই ধরনের ঘটনা ঘটার একটা বড় কারণ বর্তমানে।"

এ বিষয়ে মহিলারোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তিস্তা ব্যানার্জি বলেন, "সম্প্রতিক সময় আমরা দেখছি মায়েদের মধ্যে একটা অদ্ভুত আচরণ দেখা যাচ্ছে, সন্তানকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে। যাকে আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলি PPD অর্থাৎ পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন, যাকে বাংলায় বলে 'প্রসবত্তর বিষন্নতা। নতুন যিনি মাহচ্ছেন, গর্ভাবস্থায় মায়েদের বিভিন্ন রকম হরমোনাল পরিবর্তন ঘটে, যার কারণে তারা এই পরিস্থিতিটাকে মেনে নিতে পারে না। এরপরই সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার সন্তানকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়। পরিসংখ্যানগত দিক থেকে ১০০ জনের মধ্যে ৩০ শতাংশ মায়েদের মধ্যেই এ ধরনের প্রবণতা দেখা যায়। এক্ষেত্রে পরিবার এবং সঙ্গে সন্তানসহ বা মহিলার স্বামীকেও এবং তাকে নিজে কেও সচেতন থাকতে হবে। চিকিৎসকদের সঙ্গে ঠিকভাবে যোগাযোগ রাখতে হবে, কথা শুনে চলতে হবে এবং চিকিৎসকের কাছে স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই একইসঙ্গে যাওয়া উচিত। সেই মহিলার মধ্যে কোনও ভাবেই মানসিক সমস্যা বা অবনতি না হয়।"