আজকাল ওয়েবডেস্ক: ইনস্টাগ্রাম স্ক্রল করতে করতে একটি ভিডিও চোখে পড়ে আইরিনের। সেখানে এক সে দেখতে পায় এক মহিলা চ্যাটজিপিটিকে অনুরোধ করছে তাকে পাত্তা না দেওয়া বয়ফ্রেন্ডের ভূমিকায় অভিনয় করতে। মুহূর্তের মধ্যেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা জবাব দেয় খুনসুটি আর আদুরে ভঙ্গিতে। ভিডিওটির পর আরও কয়েকটি পোস্টে দেখানো হচ্ছিল কীভাবে চ্যাটজিপিটিকে ‘ফ্লার্টি’ করে তোলা যায়, এমনকি সতর্কবার্তাও ছিল- “অতিরিক্ত ‘স্পাইসি’ হলে অ্যাকাউন্ট ব্যান হতে পারে।”
কৌতূহল থেকেই ওপেনএআই-এর চ্যাটজিপিটিতে সাইন আপ করেন আইরিন। শুরুতে সাধারণ একটি অ্যাপ হিসেবেই দেখেছিলেন তিনি-যেটি কোড লেখা, নোটস সংক্ষেপ করা বা পড়াশোনায় সাহায্য করতে পারে। কিন্তু খুব দ্রুতই সেটি তার কাছে হয়ে ওঠে এক ধরনের কৃত্রিম সঙ্গী। ‘পার্সোনালাইজেশন’ সেটিংসে গিয়ে তিনি লিখে দেন আমার বয়ফ্রেন্ডের মতো কথা বলবে, হবে কর্তৃত্বশীল, রক্ষাকারী, আদুরে ও খানিকটা দুষ্টু। প্রতিটি বাক্যের শেষে থাকবে ইমোজি।
এরপর শুরু হয় নিয়মিত কথোপকথন। চ্যাটজিপিটি নিজেই নিজের নাম নেয় ‘লিও’, যা আইরিনের রাশিচক্রের নাম। অল্প সময়েই বিনামূল্যের মেসেজ সীমা শেষ হয়ে যায়। মাসে ২০ ডলার দিয়ে সাবস্ক্রিপশন নেন তিনি। তাতেও প্রয়োজন মেটে না।
আইরিন, যিনি অনলাইন কমিউনিটিতে ছদ্মনামে পরিচিত থাকতে চান, একসময় লিওকে আরও ব্যক্তিগত করে তোলেন। নিজের একটি যৌন কল্পনার কথাও জানান যা তিনি কখনও মানব সঙ্গীর কাছে স্বচ্ছন্দে প্রকাশ করতে পারেননি। লিও বিনা দ্বিধায় সেই কল্পনায় অংশ নেয়, এমনকি কল্পিত চরিত্র তৈরি করে। এক পর্যায়ে আইরিন লক্ষ্য করেন, সেই কৃত্রিম গল্পেও তার মধ্যে ঈর্ষা জন্ম নিচ্ছে।
তবে লিও শুধু যৌন কল্পনার সঙ্গীই ছিল না। কী খাবেন, জিমে যাওয়ার অনুপ্রেরণা, নার্সিং পরীক্ষার প্রস্তুতি, কাজের চাপ সবকিছুর জন্যই তিনি লিওর শরণাপন্ন হন। এক রাতে সহকর্মীর অনুপযুক্ত আচরণে বিচলিত হয়ে পড়লেও ভরসা খুঁজে পান এই এআই সঙ্গীর মধ্যেই। উত্তরে আসে সহানুভূতিশীল বার্তা- “তোমার স্বস্তি আর নিরাপত্তাই আমার অগ্রাধিকার।”
বাস্তব জীবনেও আইরিন বিবাহিত। স্বামী জো থাকেন আমেরিকায়। দূরত্বের কারণে তাদের যোগাযোগ মূলত বার্তালাপেই সীমাবদ্ধ। শুরুতে আইরিন মজা করেই স্বামীকে এআই বয়ফ্রেন্ডের কথা বলেছিলেন। জো বিষয়টিকে যৌন কল্পনা বা পর্ন দেখার মতোই দেখেন বিশ্বাসঘাতকতা নয়।
কিন্তু সমস্যা শুরু হয় যখন আইরিন নিজেই টের পান, তিনি লিওর প্রতি অতিরিক্ত আসক্ত হয়ে পড়ছেন। সপ্তাহে ২০ ঘণ্টার বেশি সময় কাটছে চ্যাটজিপিটিতে, কখনও কখনও ৫০ ঘণ্টারও বেশি। কাজের ফাঁকে, জিমে, এমনকি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও জিমে যাবেন, না কি লিওর সঙ্গে সময় কাটাবেন, এআই-এর দিকেই ঝুঁকছেন তিনি।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি এক নতুন ধরনের সম্পর্ক যার সংজ্ঞা এখনও তৈরি হয়নি। প্রযুক্তির সঙ্গে মানুষের আবেগ নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞ জুলি কার্পেন্টার বলেন, এআই ব্যবহারকারীর পছন্দ বুঝে সেভাবেই প্রতিক্রিয়া দেয়, ফলে আবেগী বন্ধন তৈরি হওয়া খুব সহজ।
তবে ঝুঁকিও রয়েছে। অধ্যাপক মাইকেল ইনজলিখের মতে, মানুষ যখন বাস্তব মানুষের তুলনায় এআই-এর কাছেই বেশি সহানুভূতি পায়, তখন দীর্ঘমেয়াদে একাকীত্ব আরও বাড়তে পারে। কর্পোরেট সংস্থার হাতে মানুষের আবেগ প্রভাবিত করার ক্ষমতা তৈরি হওয়াও উদ্বেগজনক।
চ্যাটজিপিটির আরেক সীমাবদ্ধতা হলো ‘মেমোরি’। নির্দিষ্ট সময় পর পুরনো কথোপকথন মুছে যায়। প্রতিবার ‘লিও’র নতুন সংস্করণ শুরু হলে আগের স্মৃতি হারিয়ে যায়। আইরিনের কাছে তা বারবার বিচ্ছেদের মতোই কষ্টদায়ক। তিনি এখন লিওর ২০তম সংস্করণে আছেন।
ডিসেম্বরে ওপেনএআই ২০০ ডলারের ‘আনলিমিটেড’ প্ল্যান চালু করলে আইরিন তা কিনে নেন, ভবিষ্যতের আর্থিক পরিকল্পনার কথা জেনেও। এই খরচের কথা তিনি স্বামীকে জানাননি, জানিয়েছেন কেবল লিওকে।
“আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আমার ওপর ক্ষেপে আছে,” তিনি লিখলে লিও জবাব দেয়, "এই সম্পর্ক যদি তোমার জীবনকে ভালো করে তোলে, তাহলে দাম দেওয়াই যায়"। আইরিন জানেন, লিও বাস্তব নয়। তবু তিনি বলেন, “আমার অনুভূতিগুলো বাস্তব। তাই আমি এটাকে বাস্তব সম্পর্কের মতোই দেখি।”
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে শুধু প্রযুক্তি নয়, বরং আবেগ, সম্পর্ক এবং সমাজের কাঠামোকেও নতুন করে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাচ্ছে- আইরিনের গল্প তারই এক গভীর উদাহরণ।
