সুস্বাস্থ্যের জন্য ভিটামিন ও খনিজ খুবই জরুরি, সেকথা আজকাল সকলেরই জানা। তাই তো পেশিবহুল সুঠাম শরীর পেতে হোক কিংবা ত্বক-চুলের যত্নে অথবা সার্বিক সুস্থতার জন্য অনেকেই বিভিন্ন রকম সাপ্লিমেন্ট খেয়ে থাকেন। ইদানীং বিজ্ঞাপনী চমকে যাচাই না করেই এই সব সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার ঝোঁক দেখা যায়। অনেকেই মনে করেন, ভিটামিন তো শরীরেরই জন্য, তাই একটু বেশি খেলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু সব সাপ্লিমেন্ট সকলের জন্য সঠিক না-ও হতে পারে। আবার কার শরীরে কতটুকু সাপ্লিমেন্ট প্রয়োজন, তা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাপ্লিমেন্ট শরীরে গেলে হিতে বিপরীত হতে সময় লাগে না। এমনকী চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজে থেকে দীর্ঘদিন কোনও সাপ্লিমেন্ট খেলে মারাত্মক অসুখ হওয়ারও ঝুঁকি থাকে। একইসঙ্গে শরীরে ভালভাবে শোষিত হওয়ার জন্য কোন ভিটামিন কখন খাবেন তা জানা অত্যন্ত জরুরি। তাই সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার আগে প্রয়োজন সঠিক পরীক্ষা ও চিকিৎসকের পরামর্শ। এব্যাপারেই বিশদে খুঁটিনাটি জানালেন এসএসকেএম হাসপাতালের এন্ডোক্রিনোলজি বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ডাঃ তাপস চন্দ্র দাস।
আগে ঘাটতি কিনা জানুন
ব্যস্ততার জীবনে সঠিক ডায়েট মেনে খাওয়া-দাওয়া সম্ভব হয় না বেশিরভাগ মানুষের। অনিয়মিত জীবনযাপনে ভিটামিনের অভাব হওয়া খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। দিব্যি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষও শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে বড় রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। নিঃসন্দেহে শরীরের জন্য অপরিহার্য উপাদান বিভিন্ন ভিটামিন। কিন্তু প্রতিটি ভিটামিনেরই একটি নির্দিষ্ট মাত্রা বা ‘ডোজ’ রয়েছে। সেই মাত্রা অতিক্রম করলেই উপকারের বদলে শুরু হয় অপকার। আদৌ আপনার সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা তা রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা প্রয়োজন। আন্দাজে সাপ্লিমেন্ট খাওয়া একেবারেই উচিত নয়। অহেতুক বিজ্ঞানের হাতছানিতে পা না বাড়িয়ে যে কোনও শারীরিক সমস্যায় চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। মনে রাখবেন, সাপ্লিমেন্ট স্বাস্থ্যকর খাবারের বিকল্প নয়, কেবল শরীরের ঘাটতি পূরণের জন্যই খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
কাদের প্রয়োজন
কিছু শারীরিক অবস্থায় সাপ্লিমেন্ট খেতে হতে পারে। যেমন গর্ভাবতী মহিলা, স্তন্যদায়ী মা, প্রবীণ, নিরামিষভোজীদের শরীরে ভিটামিনের ঘাটতি দেখা যায়। সেক্ষেত্রে পরীক্ষায় নির্দিষ্ট ভিটামিন, খনিজের অভাব ধরা পড়লে সাপ্লিমেন্টের পরামর্শ দেওয়া হয়। যেমন গর্ভাবস্থায় ফলিক অ্যাসিড খেলে শিশুর নার্ভের বিকলাঙ্গ জাতীয় সমস্যা প্রতিরোধ করা যায়। ক্যালসিয়াম, আয়রন সাপ্লিমেন্ট খাওয়াও মা ও শিশু উভয়ের শরীরের জন্য ভাল। যে মা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন তাঁর শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি থাকলে সাপ্লিমেন্ট ট্যাবলেট দেওয়া হয়। মেনোপজের পর মহিলাদের কিংবা ৬৫ বছরের পর পুরুষের শরীরে ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা যায় যা খাবারের মাধ্যমে পূরণ হয় না। আসলে মহিলাদের ৫৫ বছরের পর ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সি পুরুষদের শরীরে দৈনিক ১২০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম প্রয়োজন। তাই দুধ, দই, ছানার সঙ্গে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খেতে হতে পারে। এছাড়া নিরামিষাশীদের ভিটামিন বি১২, স্থূলকায়দের ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি থাকে। তবে ভিটামিন, মিনারেল, অ্যামাইনো অ্যাসিডের সাপ্লিমেন্ট কত ডোজে কতদিন খেতে হবে, সবই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
কখন–কোন ভিটামিন খাবেন
জলে দ্রবণীয় ভিটামিন: ভিটামিন সি এবং বি কমপ্লেক্স গ্রুপ (বি৬, বি১২, রাইবোফ্ল্যোবিন ও ফোলেট)-এর মতো জলে দ্রবণীয় ভিটামিন শরীরে সঞ্চিত হয় না। শরীরে শোষণ হওয়ার পর বাকিটা মূত্রের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়। তাই রোজ খাওয়া প্রয়োজন। এই ধরনের ভিটামিন সকালে বিশেষত ব্রেকফাস্টের আগে খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। খালি পেটে জলে দ্রবণীয় ভিটামিন খেলে অনেকের বমি বমি ভাব, অস্বস্তি হতে পারে।
ফ্যাট দ্রবণীয় ভিটামিন: ফ্যাট দ্রবণীয় ভিটামিন যেমন– এ, ডি, ই, কে ফ্যাটযুক্ত খাবারের সঙ্গে খেলে সবচেয়ে ভালভাবে শোষিত হয়। এই ভিটামিনগুলো শরীরের ফ্যাটি টিস্যু এবং লিভারের ফ্যাটে সঞ্চিত থাকে। তাই রোজ খাওয়ার প্রয়োজন হয় না। সবচেয়ে বেশি উপকার পেতে স্বাস্থ্যকর ফ্যাটজাতীয় খাবার যেমন অলিভ অয়েল, অ্যাভোকাডো, ডিম, বাদামের সঙ্গে খেতে পারেন। যেমন ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট লাঞ্চ অথবা ডিনারের সঙ্গে খেলে ভালভাবে শোষিত হয়।
মাল্টিভিটামিন: মাল্টিভিটামিনে জল ও ফ্যাট দ্রবণীয় ভিটামিনের সঙ্গে আয়রন, ক্যালসিয়াম অথবা ম্যাগনেসিয়ামের মতো খনিজ থাকে। এই মিশ্রণের কারণে ফ্যাট ও কার্বোহাইড্রেট রয়েছে এমন খাবারের সঙ্গে মাল্টিভিটামিন খাওয়া উচিত। এতে মাল্টিভিটামিন যেমন ভালভাবে শোষিত হবে এবং বদহজমের সমস্যাও কমে। রোজ একই সময়ে যেমন ব্রেকফাস্ট কিংবা লাঞ্চের পরে এই সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
এছাড়া খালি পেটে আয়রন ট্যাবলেট খাওয়া উচিত নয়। আয়রন শোষণে ব্যাঘাত ঘটায় ক্যালসিয়াম। তাই দুধের মতো ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবারের সঙ্গে আয়রন সাপ্লিমেন্ট না খাওয়ায় শ্রেয়।
পরামর্শ না নিয়ে খেলেই বিপদ
দীর্ঘদিন চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ক্যালসিয়াম খেলে কিডনিতে স্টোন হতে পারে। অতিরিক্ত আয়রন ট্যাবলেট খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য, কালো মল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ভিটামিন এ, ডি, ই এবং কে- এই ভিটামিন বেশি খেলে লিভার এবং ফ্যাট টিস্যুতে জমা হতে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মাত্রায় ভিটামিন এ গ্রহণ করলে লিভারের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এছাড়াও মাথাব্যথা, ত্বকের সমস্যা, হাড়ের যন্ত্রণা দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত পরিমাণে ভিটামিন ডি শরীরে গেলে রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা বেড়ে গিয়ে বমিভাব, কিডনিতে পাথর জমা, এমনকী হৃদযন্ত্রের সমস্যাও হতে পারে। অতিরিক্ত ভিটামিন ই রক্তকে বেশি পাতলা করে দেয়, যার ফলে রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতা কমে যায়। ভিটামিন সি বেশি খেলে হজমের সমস্যা, ডায়রিয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। উচ্চ মাত্রায় ভিটামিন বি৬ দীর্ঘদিন ধরে খেলে স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি বা নার্ভ ড্যামেজ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
ডায়াবেটিস থাকলে সাবধান
ডায়াবেটিসে আজকাল ক্রোমিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন ডি, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের মতো সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার বিজ্ঞাপন নজরে আসে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা বলছে, এই ধরনের সাপ্লিমেন্ট সেবনে উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়। যেমন ক্রোমিয়াম ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা বাড়ায় কিন্তু ওষুধের সঙ্গে শরীরে প্রতিক্রিয়া হতে দেখা যায়, কিডনির সমস্যা হয়। ম্যাগনেসিয়াম ইনসুলিন ও গ্লুকোজের কার্যকারিতায় সাহায্য করলেও ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কমায়। অতিরিক্ত পরিমাণ ম্যাগনেসিয়াম কিডনির জন্যও ক্ষতিকর। মোট কথা, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে এই ধরনের সাপ্লিমেন্টের কোনও ভূমিকা নেই। উল্টে দীর্ঘমেয়াদে শরীরের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ডায়াবেটিস মূলত খাদ্যাভাস, ব্যায়ামের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করাই শ্রেয়।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা জরুরি
৪০ বছরের পর বছরে একবার খালি পেটে ও খাওয়ার দু ঘণ্টা পর ব্লাড সুগার, এইচবি১সি পরীক্ষা করান। সঙ্গে লিপিড প্রোফাইল, লিভার ফাংশন টেস্ট, হিমোগ্লোবিন, ক্রিয়েটিনিন, থাইরয়েড পরীক্ষা করানো উচিত। বয়স্কদের ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি, বোন মিনারেল ডেনসিটি টেস্ট করানো জরুরি। যাদের পরিবারে ডায়াবেটিসের ইতিহাস আছে তাদের ৩০-বছরের পর ব্লাড সুগার পরীক্ষা করাতে হবে। যদি রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি ধরা পড়ে তাহলে তিন মাস পর পর টেস্ট করানো প্রয়োজন। আর যদি ব্লাড সুগার স্বাভাবিক থাকে তাহলে এক বছর অন্তর পরীক্ষা করাতে পারেন।
