আজকাল ওয়েবডেস্ক: বসার ঘরে সোফায় বসে আছেন বছর পঞ্চাশের অনিরুদ্ধবাবু। ছেলে আরিয়ান সবে কলেজ থেকে ফিরেছে। কানে হেডফোন, মুখে অদ্ভুত এক শব্দ ‘ইয়ো’! তার পর থেকেই মোবাইল ফোনে মুখ গুঁজে খুটখাট। খাবারের টেবিলেও সেই এক দৃশ্য। “কী রে, আজ কলেজে কী হল?” বাবার এই প্রশ্নের উত্তরে ছেলে না তাকিয়েই বলল, “চিল, বাবা। সব সর্টেড।” ‘চিল’ বা ‘সর্টেড’-এর আভিধানিক অর্থ জানলেও, ছেলের বলার ভঙ্গিতে লুকিয়ে থাকা অনুভূতিটা অনিরুদ্ধবাবুর কাছে অধরা।
এ শুধু অনিরুদ্ধবাবুর একার গল্প নয়। এ যেন জানার মাঝেই এক ‘অজানা’ দেওয়াল। নতুন প্রজন্মের ভাষা, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আর বদলে যাওয়া আদবকায়দার সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে বহু অভিভাবকই নিজেদের সন্তানের জগতে ব্রাত্য হয়ে পড়ছেন। ফল? বাড়ছে মানসিক দূরত্ব, তৈরি হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা।
সমস্যার উৎস কোথায়?
আগে প্রজন্মগত ব্যবধান মূলত চিন্তাভাবনা বা জীবনশৈলী নিয়ে ছিল। কিন্তু এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তি এবং ভাষার ভেদ। বাবা-মায়েরা যে গতিতে প্রযুক্তি শিখছেন, ছেলেমেয়েরা তার চেয়ে কয়েকশো গুণ দ্রুত গতিতে নতুন অ্যাপ, নতুন ট্রেন্ডের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। ‘মিম’, ‘রিলস’, ‘স্ন্যাপচ্যাট’ বা অনলাইন গেমিংয়ের এক নিজস্ব জগৎ রয়েছে, যার পরিভাষা বহু অভিভাবকদের কাছে আজও অজানা। ফলে সন্তানের সঙ্গে কথোপকথন শুরু করতে গিয়েই তাঁরা থমকে যাচ্ছেন।
অন্যদিকে ছেলেমেয়েরা তাদের নিজস্ব ‘স্পেস’ বা পরিসর চাইছে, যা তাদের আগের প্রজন্ম পায়নি। কিন্তু এই পরিসর খুঁজতে গিয়ে তারা কখন যে পরিবারের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, তা নিজেরাও বুঝতে পারছে না। আবার, অভিভাবকদের উদ্বেগ বা শাসন করার ভঙ্গিও অনেক সময় তাদের আরও দূরে ঠেলে দিচ্ছে সন্তানকে
করণীয় কী?
এই মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব কমাতে সবটা ছেলেমেয়েদের উপর ছাড়লে চলবে না। বরং অভিভাবকদেরই নিতে হবে মূল উদ্যোগ।
শাসন নয়, বন্ধুত্ব: সন্তানের জগতের প্রতি আগ্রহ দেখান। ধমক দিয়ে মোবাইল ফোন কেড়ে না নিয়ে, বরং জিজ্ঞাসা করুন, “কী দেখছিস? আমায় একটু বোঝাবি?” তাদের জগতে প্রবেশ করার এটাই প্রথম ধাপ। তাদের শেখানো বিষয়কে গুরুত্ব দিলে, তারা আপনাকে নিজস্ব জগতে স্বাগত জানাতে উৎসাহী হবে।
শিক্ষার্থীর ভূমিকায়: প্রযুক্তি বা নতুন ভাষা নিয়ে সন্তানের কাছে কিছু শিখতে লজ্জা পাবেন না। নিজেকে ‘সর্বজান্তা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার বদলে একজন শিক্ষার্থীর জায়গায় নামিয়ে আনুন। আপনার এই আগ্রহই সন্তানের কাছে আপনাকে বন্ধু করে তুলবে। একে মনোবিদ্যার পরিভাষায় ‘রিভার্স মেন্টরিং’ বলে।
যোগাযোগের সেতু তৈরি: এমন বিষয় খুঁজুন যা দুই প্রজন্মই একসঙ্গে উপভোগ করতে পারে। সেটা কোনও ওয়েব সিরিজ হতে পারে, একসঙ্গে বাগান করা হতে পারে, কিংবা রান্না করা হতে পারে। এই ‘কোয়ালিটি টাইম’ প্রযুক্তি-মুক্ত রাখার চেষ্টা করুন।
বিচারকের আসন থেকে সরে আসুন: সন্তানের মতামত বা পছন্দের সঙ্গে আপনার মত না-ই মিলতে পারে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাকে ‘ভুল’ বা ‘খারাপ’ বলে দাগিয়ে দেবেন না। আগে তার যুক্তিটা মন দিয়ে শুনুন। শ্রোতা হন। এতে সে আপনার উপর ভরসা করতে শিখবে এবং নিজের সমস্যার কথা আপনাকে খুলে বলতে দ্বিধা করবে না।
ব্যক্তিগত পরিসরকে সম্মান করুন: সব বিষয়ে অতিরিক্ত প্রশ্ন বা সন্তানের ব্যক্তিগত পরিসরে অকারণ হস্তক্ষেপ করবেন না। এতে আপনার প্রতিও তাদের সম্মান বাড়বে।
সবশেষে বলা যায়, দুই প্রজন্মের এই ব্যবধান রাতারাতি মুছে ফেলা সম্ভব নয়। তবে এই দূরত্ব কমানোর চাবিকাঠি অনেকটাই রয়েছে অভিভাবকদের হাতে। একটু ধৈর্য, সহানুভূতি এবং শেখার ইচ্ছেই পারে ঘরের মধ্যে গড়ে ওঠা এই অদৃশ্য দেওয়াল ভেঙে ফেলতে। প্রজন্মের ব্যবধান হয়তো থাকবে, কিন্তু তার উপর দিয়ে ভালবাসার সেতু গড়ে তোলার দায়িত্বটা অভিভাবকদেরই নিতে হবে।
