দুর্গাপুজোর পাঁচদিনে বেলাগাম খাওয়াদাওয়া। বিজয়ায় দেদার মিষ্টিমুখ। লক্ষ্মীপুজো নাড়ু, মোয়া, মিষ্টি, পায়েস ছাড়া কাটে নাকি? কালীপুজো-দীপাবলিতেও লাড্ডু থেকে পায়েস, মুখ চলেছে টুকটাক। আর ভাইফোঁটা? কবজি ডুবিয়ে খাওয়ার শেষপাত বাদ দেওয়া যায় কখনও? অতঃপর, যে পরিমাণ মিষ্টি পেটে পুরেছেন, তাকে বাগে আনার ব্যবস্থা করুন শিগগির। তা না হলে যে ভুগতে হবে আপনাকেই! 

আসলে উৎসবের মরসুমে মিষ্টি থেকে বাঙালিকে দূরে রাখা কি মুখের কথা! সারা বছর যতই শরীর সচেতন হয়ে কাটুক, এ ক’টা দিন ডায়েট কিংবা নিয়মের রাশ আলগা হয়েই যায়। এমনকী যাঁরা ডায়াবেটিসের রোগী, তাঁরাও ডাক্তারের চোখরাঙানি ভুলে নয় নয় করে খানিক বাড়তি মিষ্টি খেয়েই ফেলেন। ফলে পুজো থেকে ভাইফোঁটার এই উদযাপনী আমেজটা কেটে যেতে না যেতেই চিন্তার পারদ চড়ে। কারণ, ওজন এবং রক্তে চিনির মাত্রাও যে ঊর্ধ্বমুখী! এই বেলা তার মোকাবিলা না করলে চলবে কেন! 

উৎসবের মরসুমে শরীরে ঢুকে পড়া এই বাড়তি চিনিকে তবে কবজা করবেন কী ভাবে? 
ডায়াবেটোলজিস্ট আশিস মিত্র বলছেন, “আসলে আমরা বারবারই বলি উৎসবের সময়টাতেও প্রতিদিন বাড়তি হাঁটা কিংবা প্রত্যেক বার খাওয়ার পরে অন্তত পনেরো মিনিট পরে হাঁটা জারি রাখতে। কারণ এই সময়ে মিষ্টি, কোল্ডড্রিঙ্ক, ফাস্টফুড সবই বেশি খাওয়া হয়। এই হাঁটাহাঁটিটা যদি করা না হয় তবে ওজন কিংবা সুগারের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে বেশ খানিকটা। সেক্ষেত্রে উৎসবের মরসুম শেষ হলেই দ্রুত নরমাল ডায়েটে ফিরুন। কার্বোহাইড্রেট খাওয়া পুরোপুরি বন্ধ অথবা যথাসম্ভব কমিয়ে দিতে হবে। বদলে জোর দিতে হবে প্রোটিনে। সেই সঙ্গে বাড়িয়ে দিতে হবে এক্সারসাইজের মাত্রা। দরকারে জিমে যেতে পারেন, করতে পারেন ওয়েট ট্রেনিং। তবেই শরীরটাকে আবার বশে আনতে পারবেন। তা ছাড়া, পুজো-ভাইফোঁটা পেরিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই এসে পড়বে বড়দিন-নতুন বছর। ওই সময়টায় সবাই পার্টির মেজাজে থাকে, কেক-পেস্ট্রিও বেশি খাওয়া হয়ে যায়। একটু সচেতন হয়ে সেটা এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। এই সময়ে নতুন গুড়ের মিষ্টি, মোয়া ইত্যাদিও বেশি খেয়ে ফেলেন অনেকেই। তা খেতে চাইলে কিন্তু আগেভাগেই শরীরচর্চা বাড়াতে হবে। সাধারণ ভাবে ৪৫ মিনিট হাঁটার অভ্যাস থাকলে বাড়িয়ে দু’বেলা হাঁটুন বা জিমে যান। তাতে ওজন, সুগার সবই নিয়ন্ত্রণে থাকবে।”

আপনি যদি হন ডায়াবেটিসের রোগী, তবে আরও খানিকটা বাড়তি সাবধানতা এবং খাওয়াদাওয়ায় আর একটু কড়া হাতে রাশ টানা জরুরি। ডাক্তার মিত্রের পরামর্শ, “ডায়াবেটিস রোগীরা এই পুজো থেকে ভাইফোঁটার দৌলতে বেশি মিষ্টি খেয়ে ফেললে ওষুধ বা ইনসুলিনের ডোজ বাড়িয়ে দিন। অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে। সঙ্গে এক্সারসাইজের মাত্রাও বাড়িয়ে দিন কিছুটা। এতে শরীরে যতটা ইনসুলিন অবশিষ্ট আছে, তা ঠিকমতো কাজ করবে। নিয়মিত শরীরচর্চা করা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ভীষণ ভাবে জরুরি। প্রতিদিন সকালে ৪৫ মিনিট হাঁটা, প্রতিবার খাওয়ার পরে দশ-পনেরো মিনিট হাঁটা— এগুলো কিন্তু ওষুধ বা ইনসুলিন ছাড়াও বেড়ে যাওয়া সুগারকে আবার নিয়ন্ত্রণে আনতে সাহায্য করে।”

অনেকেই মনে করেন, ডায়াবেটিসের সমস্যা থাকলে বা আগেভাগেই রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চিনির বদলে সুগার ফ্রি বা স্টেভিয়া কার্যকরী হতে পারে। এতে চিনিও খাওয়া হয় না, আবার মিষ্টি স্বাদের সঙ্গেও আপোস করতে হয়না। কিন্তু সত্যিই কি এই বিকল্প উপকারী?

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কথায়, “সুগার ফ্রি-র মধ্যে একমাত্র স্টেভিয়া ব্যবহার করারই পরামর্শ দিই আমরা। স্টেভিয়া পাতা থেকে তৈরি এই বিকল্পকে সুগার ফ্রি ন্যাচুরা বলা হয়। এর তেমন কোনও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। রান্নায় চিনির বদলে স্টেভিয়া ব্যবহার করতে পারেন। চা-কফি-দুধেও দিয়ে খেতে পারেন। তবে হ্যাঁ, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় কিংবা বাচ্চাকে স্তন্যপান করানোর সময়কালে স্টেভিয়া ব্যবহার না করাই ভাল। কারণ এই দুই ক্ষেত্রে এখনও স্টেভিয়া নিরাপদ বলে প্রমাণিত হয়নি। সুতরাং যাঁরা ডায়াবেটিক প্রেগন্যান্সিতে আছেন কিংবা বাচ্চা মায়ের দুধ খাচ্ছে, এমন ক্ষেত্রে তাঁদের স্টেভিয়া দেওয়া চলবে না। তার বদলে প্রাকৃতিক বিকল্প ব্যবহার করতেই পারেন। যেমন, লম্বা খেজুর মানে ডেটস খেতে পারেন। ধরা যাক, ব্রেকফাস্টে দুধ-ছাতু খাচ্ছেন, তাতে চিনির বদলে দুটো এই খেজুর মিশিয়ে নিন। এতে রক্তে চিনির মাত্রা খুব বেশি কিছু বাড়বে না। তবে দিনে দুটোর বেশি খাওয়া চলবে না। চাইলে ভাল কোয়ালিটির মধুও খেতে পারেন চিনির বদলে। তবে দিনে দু’চামচের বেশি নয়। আর একটা ভাল বিকল্প হল তালমিছরি। চিনির বদলে ভাল কোয়ালিটির তালমিছরি খেলে ক্ষতি হয়না। অনেকে ভাবেন চিনির বদলে গুড় খাওয়া যায়। এতে কিন্তু সুগারের মাত্রা কমে না। চিনির বদলে গুড় খেলে তাই কোনও উপকার হয়না। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য গুড় একই রকম বিপজ্জনক।”