উদ্দালক
কোনও সভ্যতার ইতিহাস খুব একটা সাজানো গোছানো নয়। উজ্জ্বলতার ইতিহাস নিয়ে মাতামাতি হলেও, অনুজ্জ্বল, কদর্য বা অন্ধকারের ইতিহাস মানুষকে এসে দাঁড় করায় আয়নার সামনে। আর তখনই মানুষ যাচাই করতে পারে অতীতকে। শিক্ষা নিতে পারে, বা লজ্জা পেতে পারে কখনও কখনও। 'দমদম শব্দমুগ্ধ নাট্যকেন্দ্র' প্রযোজিত ব্রাত্য বসু'র 'অদামৃতকথা' উৎসারিত নাটক 'বেলবাবু' তেমনই এক আয়না ধরল মানুষের সামনে। থিয়েটারের মানুষেরা তাই এই নাটকটি দেখতে দেখতে বারংবার শিহরিত হতে পারেন, পায়ের তলার মাটি সরে যেতে পারে। না, শুধু থিয়েটারের মানুষেরা নন। লিঙ্গ বিষম্যের এই সমাজ কাঠামোর প্রিভিলেজ জেন্ডার বা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা লিঙ্গের মানুষেরাও এই নাটক থেকে একবার অন্তত দাঁড়াবেন নিজের মুখোমুখি, প্রশ্ন করবেন, যা ঘটে চলেছে চারিদিকে, তা কী ঠিক, তাই কী হওয়ার কথা?
ব্রাত্য বসুর অদামৃতকথা বাংলা থিয়েটারের একটা বিশেষ সময়ের বিভিন্ন পর্যায় ছুঁয়ে গিয়েছে। সেই উপন্যাসের একটি অংশকে উদ্ধার করে এই নাটক লিখিত হয়েছে। নাটক লিখেছেন ও নির্দেশনা দিয়েছেন রাকেশ ঘোষ। রাকেশ দীর্ঘদিন ধরেই লিঙ্গ রাজনীতি নিয়ে কাজ করছেন বাংলা থিয়েটারের মঞ্চে। এমন একনিষ্ঠ ভাবে লিঙ্গ রাজনীতি নিয়ে কাজ আর কেউ করছেন না। এই নাটকে সেই বিষয়টি পৌঁছে গিয়েছে এক নতুন উচ্চতায়। সবচেয়ে বড় কথা কোনও ভড়ং নেই, কোনও অস্বস্তি এড়ানোর মুখোশ নেই, সোজা কথা সরাসরি প্রশ্নের মতো ছুড়ে দিয়েছেন তিনি। এই দৃঢ়তা, এই শক্ত মনে প্রতিরোধের মানসিকতা তাঁর নাটককে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। নির্দেশনার প্রতিটি ধাপেও রাকেশের লিঙ্গ-রাজনৈতিক অবস্থান ও জেহাদ ঘোষণার দৃপ্ত চেতনা স্পষ্ট।
নাটকের সম্পদ নাটকের অভিনয় ও সঙ্গীত। যে কোনও বায়োগ্রাফিক্যাল বা জীবনীমূলক নাটকের অভিনেতাদের সামনে অন্য নাটকের তুলনায় চ্যালেঞ্জ বেশি থাকে। মঞ্চে গিরিশ ঘোষ, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির চরিত্রে অভিনয় করছেন যাঁরা, তাঁরা যদি সংলাপ উচ্চারণ করতে ভূল করেন, যদি তাঁদের অভিনয়ের তীব্রতা বা দক্ষতায় খামতি স্পষ্ট হয়, তা হলেই লোকে বেশিই হাসাহাসি করবে। সেই মাপকাঠি এই নাটকের অভিনেতারা অতিক্রম করেছেন শুধু নয়, তারকা ছাত্রের মতো অতিক্রম করেছেন। গিরিশ ঘোষের ভূমিকায় সুদীপ্ত দত্ত, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির ভূমিকায় পার্থপ্রতিম রায় ও অমৃতলাল বসুর ভূমিকায় তৃষিত মৈত্র এই নাটকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
নাটকে বেলবাবু ও অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন রঞ্জন বোস। রঞ্জন দমদম শব্দমুগ্ধ দলের সম্পদ। তিনি দীর্ঘদিন ধরে দর্শককে মুগ্ধ করে আসছেন। এই নাটকেও তাঁর অভিনয় এক ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে আবেগের চূড়ান্ত স্তরে নিয়ে গিয়েছে দর্শককে। তিনি সদর্প কণ্ঠে একের পর এক প্রশ্ন করেছেন আর সেই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে নাড়িয়ে দিয়েছেন অন্তর। নাটকে ক্ষেত্রমণির চরিত্রাভিনেতা কৃষ্ণা রায় আর রঞ্জনের যুগলবন্দি আমাদের এনে দাঁড় করিয়েছে লিঙ্গ রাজনীতির জটিল, কঠিন ও নির্মম প্রশ্নের সামনে।
এই নাটককে আগাগোড়া অযথা ডিজাইনের ভারমুক্ত রেখেছেন রাকেশ। যেখানে যেখানে মনে হয়েছে প্রতীক ও দৃশ্যকাব্য বিশেষ স্তর তৈরি করবে গল্পের, সেখানেই তিনি রেখেছেন সেই সব। সেই কারণে নাটক দেখতে-দেখতে কখনই নাটকের প্রতিপাদ্য থেকে চোখ সরে যায়নি দর্শকের। নাটকের আলো, মঞ্চ তাই পুরো সময়জুড়ে প্রযোজনার সঙ্গে-সঙ্গে চলেছে বহতা নদীর মতো। কখনও মনে হয়নি, তা নাটককে অযথা ভারাক্রান্ত করছে বা কেবল কায়দা দেখানোর চেষ্টা করছে। সেই কারণে পরিচালককে যেমন আলাদা করে ধন্যবাদ দিতে হয় তেমনই আলোক পরিকল্পক মনোজ প্রসাদ ও প্রক্ষেপক আকাশ প্রসাদকে। ধন্যবাদ দিতে হয় মঞ্চ পরিকল্পক দেবাশিস দত্তকেও।
যে কোনও পিরিয়ড পিস (নির্দিষ্ট কোনও সময় বা কাল ভিত্তিক, সিংহভাগ ক্ষেত্রে প্রাচীন) তৈরির একটা বিরাট ঝামেলা তার পোষাক আর সঙ্গীত। বর্তমানের শিল্পীদের পুরোনো শিল্পীদের মতো করে কিছু একটা নির্মাণ করতে হয়, যাতে কোনওভাবেই সেটিতে সমসাময়িকতার ছোঁয়া না থাকে। সেই দিক থেকেও পরিচালক পোষাক নির্মাতা হিসাবেও সফল। উত্তর কলকাতার কোনও এক সান্ধ্যকালীন কথোপকথনের যে মেজাজ এক্ষেত্রে উঠে এসেছে, পোষাকের পুঙ্খানুপুঙ্খ ঠিক না থাকলে তা এতটা প্রাণবন্ত লাগত না। একই কথা সঙ্গীত নির্মাতা অভিজিৎ আচার্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তিনি অসামান্য দক্ষতায় উনিশ শতকীয় ধ্রুপদী গানের ঢঙে এই নাটকের সঙ্গীত নির্মাণ করেছেন, যা দর্শকের মন ভরিয়েছে।
