আজকাল ওয়েবডেস্ক: নেপালে তথাকথিত জেন জেড আন্দোলন এক নাটকীয় মোড় নিয়েছে। গত মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর, পুলিশ গুলিতে প্রায় ২০ জন আন্দোলনকারী নিহত হওয়ার পর প্রবল চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি ও তাঁর মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

আন্দোলনের সূত্রপাত

নেপালের তরুণ প্রজন্ম, যাদের জেন জেড নামে অভিহিত করা হচ্ছে, মূলত দুটি ইস্যুতে রাস্তায় নামে—
১. মার্কিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর সরকারের নিষেধাজ্ঞা।
২. রাজনৈতিক মহলের অদম্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ।

যুবকদের দাবি ছিল, এই নিষেধাজ্ঞা একদিকে তাদের রোজগারের পথ বন্ধ করছে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের তথ্য আড়াল করার কৌশল। ফলে ক্ষোভ দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারীরা সরকারি ভবন, যানবাহন ও সম্পত্তি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ শুরু করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এই ভাষ্যের আড়ালে যেটা অন্তরালে ক্লে যাচ্ছে তা হল, ২০২৪ সালের  ২৯শে সেপ্টেম্বর নেপালের সুপ্রিম কোর্ট আদেশ দিয়েছিল যে সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে দেশে কার্যক্রম চালাতে হলে আগে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। এই আদেশ কার্যকর করতে সরকার ২৮শে আগস্ট একটি জনসাধারণের বিজ্ঞপ্তি জারি করে, যেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে সাত দিনের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করার নির্দেশ দেওয়া হয়। যারা রেজিস্ট্রেশন করেনি, তাদের সময়সীমা পেরিয়ে গেলে সরকার সেই প্ল্যাটফর্মগুলো নিষিদ্ধ করে দেয়। টিকটক ও ভাইবারের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান রেজিস্ট্রেশন করেছিল, কিন্তু অন্যরা তা উপেক্ষা করে। সব সভ্য দেশে এটিকে স্বাভাবিকভাবে ধরা হয় যে, আদালতের রায় বাস্তবায়ন করা সরকারের একটি মৌলিক দায়িত্ব। একইভাবে, বিচারিক রায়ের বিরোধিতা করার সঠিক পথ হলো আদালতে তা চ্যালেঞ্জ করা, সংসদে আগুন লাগানো নয়।

জেন জেড আন্দোলনে কারা লাভবান?

যদিও আন্দোলনটি আপাত দৃষ্টিতে 'অরাজনৈতিক', বাস্তবে দুই বিতর্কিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে ঘিরেই তরুণদের সমর্থন ঘনীভূত হয়েছে।

রবি লামিছানে: আমেরিকান নাগরিকত্বধারী থেকে সাংবাদিক এবং পরে রাজনীতিক। ২০২২ সালে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা পার্টি (RSP) গঠন করেন।কেলেঙ্কারির মামলায় কারাগারে বন্দি থাকা সত্ত্বেও বিক্ষোভকারীরা তাঁর মুক্তির দাবিতে মঙ্গলবার নাখু জেল ঘেরাও করে। বিক্ষোভকারীদের হুমকির মুখে কর্তৃপক্ষ তাঁকে বের করে এনে বক্তব্য দিতে বাধ্য হয়। গুজব আছে, আগুন লাগানোর হুমকির কারণে তাঁকে মুক্তিও দেওয়া হতে পারে। তাঁর রাজনৈতিক লাইন স্পষ্টভাবে নয়া উদারবাদী: বেসরকারিকরণ, বিদেশি বিনিয়োগ ও ব্যক্তি পুঁজির সম্প্রসারণ। 

বলেন্দ্র শাহ (বেলেন): র‍্যাপার থেকে স্বাধীন রাজনীতিক। ২০২২ সালে কাঠমান্ডু মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। দুর্নীতি বিরোধী স্লোগানের আড়ালে শহরের হকার ও বস্তিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন। তরুণদের কাছে বিকল্প রাজনীতির প্রতীক হলেও তাঁর নীতি কাঠামোও নয়া উদারবাদী। এই দুই নেতার উত্থান পশ্চিমা ভাবধারার রাজনীতিকে এগিয়ে দিচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

পশ্চিমী যোগ? 

আন্দোলনের হিংসাত্মক  চরিত্র এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান আক্রমণের ধরণ পশ্চিমী পৃষ্ঠপোষক ‘রঙ বিপ্লব’-এর টেমপ্লেটের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।অস্ট্রেলিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, নরওয়ে, দক্ষিণ কোরিয়া, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ একাধিক দেশের দূতাবাস যৌথ বিবৃতি দিয়ে “শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা”র প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। তবে বিদ্রূপাত্মকভাবে, একই সময়ে আমেরিকা ও ব্রিটেন গাজা গণহত্যা বিরোধী প্রতিবাদ দমন করেছে, বহু আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করেছে।

আইএমএফ, অর্থনীতি ও সামাজিক মাধ্যম ইস্যু

নেপালের অর্থনীতি ৩৩% রেমিট্যান্স নির্ভর। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে রাজস্ব বাড়াতে। ফলে জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি ও সামাজিক মাধ্যমের ওপর ডিজিটাল ট্যাক্স বসানো হয়। সরকার মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে দেশে রেজিস্ট্রেশন করতে নির্দেশ দেয়। টিকটক ও উইচ্যাট (চীনা প্ল্যাটফর্ম) মান্য করলেও, মেটা (ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ) ও গুগল (ইউটিউব) অস্বীকৃতি জানায়। নিষেধাজ্ঞার ফলে কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের বিপুল ক্ষতি হয়। যুব বেকারত্ব ২০২৪ সালে ২০.৮২%-এ পৌঁছায়।


নেপথ্যের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

২০০৬ সালে রাজতন্ত্র পতনের পর থেকে নেপালে স্থায়ী সরকার টিকে নেই। কমিউনিস্ট দলগুলো (CPN, UML, মাওবাদী সেন্টার) সংসদে বড় ভূমিকা রাখলেও তাদের নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে জোটসর্বস্ব রাজনীতি ও আদর্শগত দ্বিধার কারণে জনগণের আস্থা হারিয়েছে। না করা হয়েছে সম্পদের জাতীয়করণ, না ভূমি সংস্কার। এর সুযোগ নিয়েছে নতুন প্রজন্মের পশ্চিম ঘেঁষা রাজনীতিকরা। একইসঙ্গে ভারতের হিন্দুত্ববাদী শক্তির মদতে রাজতন্ত্রপন্থীরা ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে, ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্লোগান তুলছে।

প্রধানমন্ত্রী ওলি চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন এবং সম্প্রতি চীনের এক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে পশ্চিমী দেশগুলোর অসন্তোষ ডেকে আনেন। ৫–৭ সেপ্টেম্বর ললিতপুরে UML দলের সম্মেলনের পরই ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। ৯ সেপ্টেম্বরের গুলিবর্ষণ ও ২০ তরুণের মৃত্যুর পর পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়। রাষ্ট্রপতি ভবনে হামলা হয়, সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়। সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা ঐতিহ্যগতভাবে রাজতন্ত্রপন্থী বলে পরিচিত। আলোচনায় আছে, সামরিক তত্ত্বাবধানে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে বালেন্দ্র শাহকে তার নেতৃত্বে বসানো হতে পারে। এতে পশ্চিমা সংস্কারপন্থীরা তাদের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক রদবদল দ্রুত চালু করতে পারবে। জেন জি-রা অন্তবর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে যাঁদের নাম পছন্দ করছেন একে একে, ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে তাঁদের ভারত যোগ। বালেন্দ্র, সুশীলার পর কুলমনও।

আরও পড়ুন:  গুলি-জলকামান-চাপ চাপ রক্ত, ছড়িয়ে ছিটিয়ে মৃতদেহ, পরিস্থিতি বিবেচনায় 'অ্যাপ ব্যান' নিয়ে পুনর্বিবেচনায় নেপাল সরকার? 

নেপালের জেন জেড আন্দোলন আপাতত দুর্নীতি ও সামাজিক মাধ্যম নিষেধাজ্ঞা বিরোধী ক্ষোভ থেকে জন্ম নিলেও, এর গতিপথ পশ্চিমী ‘রঙ বিপ্লব’ মডেলের মতোই এগোচ্ছে। ওলির পদত্যাগ, সেনার ক্ষমতা দখল, নয়া উদারবাদী দুই রাজনীতিকের উত্থান এবং পশ্চিমি দূতাবাসের প্রকাশ্য সমর্থন—সব মিলিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠছে, হিমালয়ের উপকন্ঠে এই ছোট্ট রাষ্ট্রে আসলেই কি নতুন করে পশ্চিমা প্রভাব বিস্তারের খেলা শুরু হলো? দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত প্রভাব বাড়াতে এবং চীনকে ঠেকাতে প্রথমে বাংলাদেশ এবং তারপরে নেপাল প্রচ্ছন্ন মদতদাতা কি আমেরিকা?

এখন মূল প্রশ্ন: এই বিশৃঙ্খলা থেকে নেপালের তরুণ প্রজন্ম কী পাবে—আকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন, নাকি বিদেশি শক্তির চাপিয়ে দেওয়া 'সংস্কার'? ঠিক যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে "মুক্তির একটাই পথ...খিলাফত, খিলাফত!"