আজকাল ওয়েবডেস্ক: তিন দশকেরও বেশি সময় পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবারও পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা শুরু করতে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন যে তিনি পেন্টাগনকে অবিলম্বে পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের শেষ পারমাণবিক পরীক্ষা হয়েছিল ১৯৯২ সালে, যার পর দেশটি ভবিষ্যতে পরীক্ষার ওপর স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা বা মোরাটোরিয়াম ঘোষণা করেছিল।
ট্রাম্প তাঁর এক বিবৃতিতে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের হাতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। আমার প্রথম মেয়াদকালে এসব অস্ত্র সম্পূর্ণ আধুনিকীকরণ ও সংস্কার করা হয়। ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার কারণে আমি এটা করতে চাইনি, কিন্তু অন্য দেশগুলোর পরীক্ষার কারণে আমাকে বাধ্য হতে হয়েছে। তাই আমি ‘ডিপার্টমেন্ট অফ ওয়ার’-কে নির্দেশ দিয়েছি সমান ভিত্তিতে আমাদের অস্ত্র পরীক্ষার কাজ শুরু করতে।”
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কারণ, রাশিয়া এবং চীন—যাদেরকে ট্রাম্প দোষারোপ করছেন—দীর্ঘদিন ধরেই কোনও পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়নি। রাশিয়ার শেষ পরীক্ষা হয়েছিল ১৯৯০ সালে নভায়া জেমলিয়াতে এবং চীনের শেষ পরীক্ষা ১৯৯৬ সালে তিব্বতের লপ নর পরীক্ষাকেন্দ্রে। এরপর থেকে উভয় দেশই পরীক্ষার বিরতিতে রয়েছে।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীন—এই তিন দেশই Comprehensive Nuclear Test Ban Treaty (CTBT)-এর স্বাক্ষরকারী। যদিও কেউই এখনো চুক্তিটি আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন (ratify) করেনি। ১৯৯৬ সালে এই চুক্তি খোলার পর কেবল তিনটি দেশ পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছে—ভারত ও পাকিস্তান ১৯৯৮ সালে, এবং উত্তর কোরিয়া ২০০৬ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে।
মার্কিন গণমাধ্যমের দাবি, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত রাশিয়ার নতুন অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার পরীক্ষার প্রতিক্রিয়া হতে পারে। যদিও এসব পরীক্ষা পারমাণবিক নয়, বরং কেবল অস্ত্র পরিবহন প্রযুক্তি সংক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্র নিজেও কখনও এসব গবেষণা বন্ধ করেনি।
ট্রাম্পের এই ঘোষণা এমন এক সময় এসেছে যখন তিনি সিওলে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করতে যাচ্ছেন। ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যমে এই বৈঠককে “G2 সম্মেলন” বলে উল্লেখ করেছেন, যা ইঙ্গিত দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে সম্ভাব্য দিক পরিবর্তনের। অর্থাৎ, চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবর্তে এক ধরনের যৌথ আন্তর্জাতিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার ধারণা সামনে আসছে।
“জি-টু” বা “G2” ধারণাটি প্রায় ১৫ বছর আগে অর্থনীতিবিদ ফ্রেড বার্গস্টেন ও প্রাক্তন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জবিগনিউ ব্রেজিনস্কি প্রস্তাব করেছিলেন। তবে বাস্তবে এই ধারণা খুব সীমিত সময়েই প্রয়োগযোগ্য হয়েছে।
যেহেতু CTBT এখনো কার্যকর হয়নি, তাই যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষায় আইনি বাধা নেই। তবে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষার সিদ্ধান্ত রাশিয়া ও চীনকেও নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডারের ‘নির্ভরযোগ্যতা যাচাই’ ও নতুন নকশা পরীক্ষার অজুহাত দেবে। এতে বিশ্বব্যাপী নতুন এক পারমাণবিক প্রতিযোগিতার সূচনা হতে পারে।
১৯৯০-এর দশকে ক্লিনটন প্রশাসনের সময় যুক্তরাষ্ট্র CTBT চুক্তি প্রচার করেছিল মূলত দুটি কারণে—প্রথমত, সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রভাণ্ডার ছিল রাশিয়া ও চীনের চেয়ে অনেক বড়; দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র কম্পিউটার সিমুলেশন প্রযুক্তিতে অগ্রসর ছিল, যার মাধ্যমে বাস্তব বিস্ফোরণ ছাড়াই নতুন অস্ত্র নকশা যাচাই করা সম্ভব হতো।
ভারতের ক্ষেত্রেও এই নতুন পরিস্থিতির তাৎপর্য রয়েছে। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত যে 123 Agreement স্বাক্ষর করেছিল, তাতে ভারতের পারমাণবিক পরীক্ষার ওপর পরোক্ষভাবে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছিল। তবে সেই চুক্তির ধারা ১৪.২ অনুযায়ী, ভারত চাইলে নিরাপত্তা পরিস্থিতির পরিবর্তনকে (changed security environment) পরীক্ষার যৌক্তিক কারণ হিসেবে উল্লেখ করতে পারে। অর্থাৎ, যদি যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক পরীক্ষা পুনরায় শুরু করে, ভারতও তেমন পদক্ষেপের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে পারবে।
চুক্তির আরও একটি ধারা (২.৪) স্পষ্ট করে যে, এই চুক্তি কেবল শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক সহযোগিতার জন্য, ভারতের সামরিক কর্মসূচির ওপর এর কোনও প্রভাব নেই।
উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালে ভারতের পোখরান-২ পরীক্ষার সময় অনেক বিজ্ঞানী, বিশেষ করে পি. কে. আয়ঙ্গার, দাবি করেছিলেন যে ভারতের থার্মোনিউক্লিয়ার বোমার পরীক্ষা সম্পূর্ণ সফল হয়নি এবং আরও পরীক্ষা প্রয়োজন। তবে সেই সময় প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা আর. চিদাম্বরম বলেন, সামরিক প্রয়োজনে আরও কোনও পরীক্ষার প্রয়োজন নেই।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক পরীক্ষার পুনরারম্ভের ঘোষণার পর ভারতীয় কৌশলবিদ ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে আবারও নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হতে পারে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এটি দক্ষিণ এশিয়ায় পারমাণবিক প্রতিযোগিতা পুনরুজ্জীবিত করতে পারে—যেখানে ভারত পরীক্ষা চালালে পাকিস্তানও সেই পথ অনুসরণ করবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ শুধু আন্তর্জাতিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ কাঠামোকে দুর্বল করবে না, বরং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার ভারসাম্যকেও বিপন্ন করে তুলবে। বিশ্ব এখন অপেক্ষা করছে—ওয়াশিংটনের এই সিদ্ধান্তের জবাবে মস্কো, বেজিং এবং নয়াদিল্লি কী অবস্থান নেয়, সেটাই নির্ধারণ করবে আগামী দিনের পারমাণবিক রাজনীতির দিকনির্দেশ।
