আজকাল ওয়েবডেস্ক: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মধ্যরাতে বাংলাদেশী সেনা অফিসারদের হাতে নির্মমভাবে খুন হতে হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেই সময় দেশে না থাকায় প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। ২০২৫ সালেও তিনি বাংলাদেশে নেই। কিন্তু ফাঁসির সাজা এড়াতে পারলেন না। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলা দায়ের হয়েছিল। সেই মামলায় হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। সোমবার ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাঁর ফাঁসির সাজা ঘোষণা করেছে। এই রায়ে বাংলাদেশের দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৫০ বছরের যাত্রা সম্পন্ন হল।

মৃত্যুদণ্ডের সাজা ঘোষণার পর কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তিনি বলেন, “এই রায় দিয়েছে একটি অনির্বাচিত সরকারের প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত রিগড ট্রাইব্যুনাল। যার মূল লক্ষ্য আওয়ামী লিগকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দুর্বল করে দেওয়া।” হাসিনা জানান, তিনি বাংলাদেশের জনগণের জন্য কাজ করে যাবেন এবং প্রতিটি অন্যায়ের জবাবদিহি করা হবে।

গণহত্যায় বেঁচে যাওয়া

১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই পরমাণু বিজ্ঞানী স্বামীর কাছে জার্মানি চলে যান হাসিনা এবং তাঁর বোন রেহানা। তাঁদের বিমানবন্দরে ছাড়তে এসেছিলেন পরিবারের সদস্যরা। তখন হাসিনা জানতেন না যে, এটিই তাঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ। 

২০২২ সালে ভারত সফরে একটি সর্বভারতীয় সংবাদ সংস্থাকে দেওয়ে একটি সাক্ষাৎকারে হাসিনা বলেছিলেন, “আমার স্বামী বিদেশে থাকায়, আমিও একই বাড়িতে থাকতাম (আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে)। সেদিন সবাই সেখানে ছিল: আমার বাবা, মা, আমার তিন ভাই, দুই নববিবাহিতা ভগ্নিপতি, সবাই সেখানে ছিল।”

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকার ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর স্ত্রী-সহ পরিবারের সকলকে গুলি করে হত্যা করে বাংলাদেশী সেনারা একটি দল। মোট ৩৬ জনকে হত্যা করা হয়। বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান হিসেবে গণ্য এটিকে। এর পরে হাসিনা, তাঁর স্বামী এবং সন্তান সজীব ওয়াজেদ এবং সায়মা ওয়াজেদ এবং তাঁর বোন রেহানা ভারতে আশ্রয় নেন। 

জনপ্রিয় নেত্রী

১৯৮১ সালে ভারতে থাকার সময়েই তিনি আওয়ামি লিগের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। সেই পদে এক সময় ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর বাংলাদেশ বিএনপি সরকার গঠন করে এবং আওয়ামি লিগ ছিল প্রধান বিরোধী দল। হাসিনা বিরোধী দলনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে হাসিনার আওয়ামি লিগ দুর্দান্ত ফল করে এবং তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৯ সালে হাসিনা পুনরায় নির্বাচিত হন এবং গত বছর ক্ষমতাচ্যুত না হওয়া পর্যন্ত তিনি শীর্ষ পদে বহাল থাকেন।

হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যে কয়েক বছর ছিলেন সেই সময় ঢাকার সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক আরও জোরদার হয়েছে। সীমান্ত নিরাপত্তা থেকে শুরু করে অবকাঠামোগত সহযোগিতা এবং সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযান। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর বছরগুলিকে দিল্লি-ঢাকা সম্পর্কের স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের পর হাসিনার হস্তান্তরের জন্য নতুন সরকারের ক্রমাগত চাপ সত্ত্বেও, দীর্ঘদিনের এই সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের কারণেই ভারত তাঁকে আশ্রয় দেয়।

পলাতক প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর চতুর্থ মেয়াদ শুরু করার কয়েক মাস পর, বাংলাদেশে সংরক্ষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। সে দেশের সংরক্ষণ ব্যবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যরা অর্থাৎ যাঁরা ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন তাঁদের পরিবারের সদস্যরা চাকরি এবং শিক্ষায় অগ্রাধিকার পেতেন।

বিক্ষোভের জবাবে হাসিনা মন্তব্য করেন, “যদি মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা না পায়, তাহলে কি রাজাকারদের নাতি-নাতনিরা সেটা পাবে।”

এই মন্তব্যের ফলে কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করে এবং তাঁর অপসারণের দাবিতে পূর্ণাঙ্গ আন্দোলনে রূপ নেয়। হাসিনা কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এর প্রতিক্রিয়া জানান। অনেকের দাবি, এই আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে।

রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন আন্দোলন দমন করতে ব্যর্থ হয়, এবং বিক্ষোভকারীরা হাসিনার বাসভবনে পৌঁছয়। তাঁকে বোন রেহানার সঙ্গে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়। তখন থেকে তিনি এখানেই আছেন।

এর ১৫ মাস পরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের একটি আদালত আজ তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে এবং বলেছে যে তিনি সহিংসতা উস্কে দিয়েছেন, বিক্ষোভকারীদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন এবং অসামরিক জনগণকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আদালত আরও বলেছে যে সমন সত্ত্বেও হাসিনা বিচারে যোগ দেননি এবং বলেছে যে তাঁর ‘অনুপস্থিতি অপরাধের ইঙ্গিত দেয়’।