আজকাল ওয়েবডেস্ক: আমাদের পায়ের অনেক গভীরে, পৃথিবীর শিলাময় ম্যান্টল ও গলিত বাইরের কেন্দ্রের নিচে রয়েছে একটি ঘন, কঠিন গোলক লোহা এবং কার্বনের মতো অন্যান্য উপাদান দিয়ে গঠিত। এই অভ্যন্তরীণ কেন্দ্র বা ইনার কোর হল পৃথিবীর সবচেয়ে গোপন রহস্য, যা আমাদের গ্রহকে রক্ষা করা চৌম্বকক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। তবুও, বিজ্ঞানীরা এখনও বুঝতে চেষ্টা করছেন এটি প্রথম কবে গঠিত হয়েছিল এবং কোন উপাদানগুলো এর স্ফটিকায়নে সাহায্য করেছিল।
লিডস বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের গবেষকদের একটি নতুন গবেষণা এবিষয়ে নতুন ধারণা দিচ্ছে। তাদের আবিষ্কারে দেখা গেছে, বিলিয়ন বছর আগে ইনার কোরকে কঠিনে পরিণত করতে কার্বনই হয়তো প্রধান উপাদান ছিল। পৃথিবীর কোরের গঠন শুধু এর ঘনত্বই নয়, এর তাপীয় ও চৌম্বক বৈশিষ্ট্যও নির্ধারণ করে।
আরও পড়ুন: ৩৭৫ দিনের নতুন স্কিম চালু করল এই ব্যাঙ্ক, বিনিয়োগেই মিলবে বাম্পার অফার
ভূকম্পবিদ্যার গবেষণা দেখায়, কোর খাঁটি লোহা থেকে কম ঘন, অর্থাৎ হালকা উপাদানও এর মধ্যে থাকতে হবে। সিলিকন, সালফার, অক্সিজেন এবং কার্বন—সবকেই প্রার্থী হিসেবে ধরা হয়েছিল। সর্বশেষ সিমুলেশনগুলো দেখিয়েছে, বিশেষ করে কার্বন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কার্বন না থাকলে ইনার কোর স্ফটিকায়নের জন্য অসম্ভব শর্ত পূরণ করতে হতো, ফলে এর অস্তিত্বই রহস্য হয়ে যেত।
শুধু গলিত লোহা থাকলে, বিজ্ঞানীদের অনুমান ছিল ৮০০ থেকে ১০০০ °C অতিরিক্ত ঠান্ডা হওয়া দরকার। যদি তা ঘটত, তবে পৃথিবীর ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়ত। ইনার কোর খুব দ্রুত বেড়ে যেত, পৃথিবীর ভেতরের তাপপ্রবাহের সূক্ষ্ম ভারসাম্য নষ্ট হতো এবং জীবনরক্ষাকারী চৌম্বকক্ষেত্র অস্থিতিশীল হয়ে পড়ত। কিন্তু বিজ্ঞানীরা জানেন, তা ঘটেনি। ভূ-ভৌত প্রমাণ বলছে, প্রকৃতপক্ষে অতিরিক্ত ঠান্ডা হওয়া সীমিত ছিল মাত্র ২৫০ °C (৪৮২ °F) পর্যন্ত। এই সামান্য পার্থক্য—তাত্ত্বিক অনুমান আর পর্যবেক্ষিত বাস্তবতার মধ্যে—বিজ্ঞানীদের কয়েক দশক ধরে বিভ্রান্ত করেছে।
তারা সিলিকন, সালফার, অক্সিজেন ও কার্বন পরীক্ষা করেছেন এবং দেখেছেন প্রতিটি উপাদান কীভাবে জমাট বাঁধার প্রথম ধাপে—নিউক্লিয়েশন—প্রভাব ফেলে। ফলস্বরূপ, এগুলো ব্যাখ্যা করতে পারে কেন আমাদের একটি কঠিন ইনার কোর আছে কিন্তু অতিরিক্ত ঠান্ডা হওয়া তুলনামূলকভাবে কম। এক বা একাধিক উপাদান উপস্থিত থাকলে কোর খাঁটি লোহা থেকে কম ঘন হয়, যা ভূকম্পবিদ্যার একটি প্রধান পর্যবেক্ষণের সাথে মিলে যায়। সিমুলেশনগুলোতে দেখা গেছে, সিলিকন ও সালফার আসলে জমাট বাঁধা বাধাগ্রস্ত করে, ফলে বেশি ঠান্ডা হওয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু কার্বন উল্টো প্রভাব ফেলে।

২.৪% কার্বন থাকলে প্রয়োজনীয় ঠান্ডা হওয়া নেমে আসে প্রায় ৪২০ °C (৭৮৮ °F)-এ। যদিও এখনও অনেক বেশি, কিন্তু বাস্তবতার কাছাকাছি। আরও বাড়িয়ে ধরলে, ৩.৮% কার্বন থাকলে এটি নেমে আসে ২৬৬ °C (৫১১ °F)-এ, যা ভূতাত্ত্বিক প্রমাণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এতে বোঝা যায়, এপর্যন্ত কার্বনই একমাত্র উপাদান, যা একদিকে জমাট বাঁধতে সাহায্য করেছে এবং অন্যদিকে ভূকম্পবিদ্যার পর্যবেক্ষণের সাথে মিলে গেছে। মেঘে ধূলিকণাকে কেন্দ্র করে শিলাবৃষ্টি তৈরি হলেও পৃথিবীর কোরে কোনো “নিউক্লিয়েশন সিড” ছিল না। সম্ভাব্য সিড উপাদান যেমন অক্সাইড বা ধাতু, এগুলো কেন্দ্রে পৌঁছানোর আগেই গলে বা মিশে যেত। পৃথিবীর ইনার কোর কীভাবে তৈরি হল তা অধ্যয়ন করে আমরা শুধু অতীত জানছি না। আমরা এমন এক অঞ্চলের রসায়ন সম্পর্কে শিখছি, যেখানে আমরা সরাসরি কখনও পৌঁছাতে পারব না, এবং জানতে পারছি ভবিষ্যতে এটি কীভাবে বদলাতে পারে।
এই গবেষণা ইনার কোর কখন গঠিত হয়েছিল তারও হিসাব কষতে সাহায্য করছে। কেউ বলেন এটি ২০০ কোটি বছর আগে শুরু হয়েছিল, আবার কেউ বলেন ৫০ কোটি বছরেরও কম সময় আগে। কার্বনকে প্রধান উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করার ফলে বিজ্ঞানীরা এই সময়সীমা সংকীর্ণ করতে পারছেন। ফলে আরও ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে পৃথিবীর গভীর ইঞ্জিন কীভাবে বিকশিত হয়েছে, চৌম্বকক্ষেত্র, পৃষ্ঠের অবস্থা এবং এমনকি দীর্ঘমেয়াদে জীবনের উপযোগিতা কীভাবে প্রভাবিত হয়েছে।

