আজকাল ওয়েবডেস্ক: এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। প্রশান্ত মহাসাগরের অতল গভীরে এক নতুন প্রজাতির মোলাস্ক বা শামুক-জাতীয় প্রাণীর সন্ধান মিলল। জাপানের কাছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৯,৪৩০ ফুট (প্রায় ৬ কিলোমিটার) নীচে আবিষ্কৃত এই লিম্পেট প্রজাতিটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাথিলেপেটা ওয়াডাৎসুমি’। গভীর সমুদ্রে প্রাণের অস্তিত্বের সীমা নিয়ে প্রচলিত ধারণাকে এই আবিষ্কার এক নতুন দিশা দেখাল। ‘জোসিস্টেমেটিক্স অ্যান্ড ইভোলিউশন’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে এই প্রজাতির গঠন, জিনগত বৈশিষ্ট্য এবং গভীর সমুদ্রে গবেষণার ক্ষেত্রে সাবমার্সিবল প্রযুক্তির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
টোকিও থেকে প্রায় ৩০০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে একটি আগ্নেয়গিরির পাথরের উপর প্রথম এই মোলাস্কটিকে দেখা যায়। প্রথম দেখায় এটিকে সাধারণ লিম্পেটের মতোই মনে হয়েছিল। কিন্তু সাধারণ লিম্পেটদের বাস যেখানে অগভীর জলের তলায়, সেখানে এই প্রজাতিটি বাস করে সমুদ্রের অনেক গভীরে। প্রাণীটি প্রায় ১.৬ ইঞ্চি (৪০.৫ মিলিমিটার) লম্বা। ঈষৎ নীল-ধূসর রঙের স্বচ্ছ খোলসটি এই গভীরতায় আগে কখনও দেখা যায়নি। অগভীর জলে থাকা তার নিকট আত্মীয়দের থেকে ভিন্ন এই লিম্পেটটি সমুদ্রের তলদেশে দিব্যি বেঁচে থাকে। সেখানে সূর্যের আলো পৌঁছায় না এবং পরিবেশ অত্যন্ত প্রতিকূল।
জাপান এজেন্সি ফর মেরিন-আর্থ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি - এর প্রধান বিজ্ঞানী চং চেন জানিয়েছেন, আন্টার্কটিকা এবং চিলির মতো জায়গায় পাওয়া অন্যান্য পরিচিত প্রজাতির তুলনায় এই নতুন মোলাস্কটির শারীরিক গঠন এবং জিনগত বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা। চেন লিখেছেন, "বিশেষ ডুবোযানের জানালা দিয়ে একাধিক প্রাণী দেখা গেলেও, ‘হলোটাইপ’ অর্থাৎ মূল নমুনা হিসেবে একটিকেই সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে।" এই একটি নমুনাই এখন বাথিলেপেটা প্রজাতীর গভীর সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র এবং জিনগত ইতিহাস বোঝার চাবিকাঠি।
এই আবিষ্কারের নেপথ্যে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেছে সাবমার্সিবল বা বিশেষ ডুবোযান। এটি গভীর সমুদ্র অন্বেষণের জন্য একটি অপরিহার্য হাতিয়ার। এই যানগুলির সাহায্যে গবেষকরা সরাসরি প্রাকৃতিক পরিবেশে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র পর্যবেক্ষণ করতে এবং দুর্গম স্থান থেকে প্রাণী সংগ্রহ করতে পারেন। চেনের কথায়, "এই বাসস্থানগুলিতে পৌঁছনোর জন্য সাবমার্সিবলের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে বাথিলেপেটার মতো প্রাণীদের সরাসরি পর্যবেক্ষণ ও সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে, যা আগে আমাদের নজর এড়িয়ে যেত।"
‘বাথিলেপেটা ওয়াডাৎসুমি’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কারণ এটি প্রচণ্ড চাপ এবং প্রতিকূল তাপমাত্রার মতো চরম পরিস্থিতিতেও বেঁচে থাকতে সক্ষম। ১৯,৪৩০ ফুট গভীরে বসবাস করে এটি প্যাটেলোগ্যাস্ট্রোপড (এক প্রকার লিম্পেট পরিবার) প্রজাতির মধ্যে গভীরতম স্থানে বসবাসের নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে। এই আবিষ্কার ইঙ্গিত দেয় যে, গভীর সমুদ্রের তলদেশে হয়তো এমনই আরও অনেক প্রজাতি লুকিয়ে আছে, যা সাধারণ নমুনা সংগ্রহের পদ্ধতিতে ধরা পড়ে না।
এই আবিষ্কার গভীর সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের ধারণাকেও বদলে দিয়েছে। বহু বছর ধরে গবেষকরা মনে করতেন যে, গভীর সমুদ্রের সমভূমি বা অ্যাবিসাল প্লেইন একটি বৈশিষ্ট্যহীন বিস্তীর্ণ অঞ্চল। কিন্তু নতুন এই তথ্য প্রমাণ করছে যে, পাথুরে পৃষ্ঠের অস্তিত্ব ধারণার চেয়ে অনেক বেশি, যা ‘বাথিলেপেটা ওয়াডাৎসুমি’-এর মতো প্রজাতির বাসস্থান হিসেবে কাজ করে।
‘বাথিলেপেটা ওয়াডাৎসুমি’-র স্বতন্ত্রতা প্রমাণে জিনগত গবেষণা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিজ্ঞানীরা শারীরিক পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি COI জিনের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে প্রজাতিটির বিবর্তনগত অবস্থান নির্ণয় করেছেন। ফাইলোজেনেটিক বিশ্লেষণ থেকে অনুমান করা হচ্ছে যে, বাথিলেপেটার মতো প্রকৃত লিম্পেটরা কোনও এক সময়েই গভীর সমুদ্রে বসবাস শুরু করে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। এই আবিষ্কার লিম্পেটদের গভীরতায় বসবাসের সীমা আরও বাড়িয়ে দিল। পাশাপাশি প্রমাণ করল যে কিছু প্রজাতি চরম পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার জন্য বিশেষভাবে অভিযোজিত হয়েছে।
