আজকাল ওয়েবডেস্ক: জাপানের সুশিমা দ্বীপে আবিষ্কৃত এক উজ্জ্বল নীল রঙের, ছয়-চোখওয়ালা স্প্রিংটেইল বিজ্ঞানীদের কাছে এক চমকপ্রদ নতুন বিবর্তনীয় রহস্য উন্মোচন করেছে। গবেষকদের মতে, ক্ষুদ্রাকৃতির এই প্রাণীর দৈর্ঘ্য মাত্র ০.০৬ থেকে ০.০৭ ইঞ্চি, অর্থাৎ চালের দানার চেয়েও ছোট। এর মাথার দুই পাশে তিনটি করে মোট ছয়টি চোখ রয়েছে, যা দুই সারিতে নিখুঁতভাবে সাজানো।
এই গবেষণার নেতৃত্ব দেন জাপানের নারা প্রদেশের কিনদাই ইউনিভার্সিটির হিরো কাসাই। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ‘কলেম্বোলা’ নামে পরিচিত ক্ষুদ্র ছয়-পা প্রাণীদের নিয়ে কাজ করে আসছেন। এরা সাধারণত মাটির পচনশীল স্তরে বাস করে এবং ক্ষুদ্রাকৃতির হলেও শক্তিশালী লাফ দেওয়ার ক্ষমতার জন্য পরিচিত। কাসাই তাঁর গবেষণাপত্রে লিখেছেন, “এই গবেষণায় আমরা প্যারানুরা গণের চারটি নতুন প্রজাতি বর্ণনা করেছি।” এর মধ্যে অন্যতম হল Paranura tsushimaensis, যেটি সুশিমা দ্বীপে সংগ্রহ করা হয় এবং এর দেহে ছয়টি স্পষ্ট কালো চোখ দেখা যায়। গবেষকেরা পচা ডালের ভেতর থেকে দুইটি স্ত্রী, তিনটি পুরুষ এবং একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক নমুনা সংগ্রহ করেন।
অন্যদিকে, নিগাতা প্রদেশের সাদো দ্বীপে মৃত ডালপালা থেকে ছয়টি স্ত্রী স্প্রিংটেইল পাওয়া যায়, যেগুলো Paranura nakamurai নামে নতুন প্রজাতি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। হলদে-সাদা রঙের এই প্রজাতির দৈর্ঘ্য ০.০৩ থেকে ০.০৬ ইঞ্চির মধ্যে। গবেষকেরা জানান, এটির নামকরণ করা হয়েছে কাহিতো নাকামুরার সম্মানে, যিনি প্রথম প্রজাতিটি খুঁজে পান।
নারা এলাকার মাউন্ট শ্যাকাগাটাকে পাহাড়ি বনে গবেষকেরা পাঁচটি স্ত্রী এবং একটি পুরুষ নমুনা সংগ্রহ করেন Paranura alpicola প্রজাতির। প্রায় ০.০৫ থেকে ০.০৯ ইঞ্চি দীর্ঘ এই প্রজাতির দেহ মোটা ও হলুদ রঙের।
এছাড়াও, ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে নারার বিভিন্ন স্থানে চালানো সমীক্ষায় আরেকটি নতুন প্রজাতি Paranura convallis এর সন্ধান পাওয়া যায়। কমলা রঙের এই প্রজাতির দেহ তুলনামূলক ছোট এবং এটি ছয়টি চোখযুক্ত। দৈর্ঘ্য প্রায় ০.০৬ থেকে ০.০৯ ইঞ্চি।
গবেষকেরা জানান, এই ক্ষুদ্র আর্থ্রোপডদের রঙিন দেহ কেবল শারীরিক বৈশিষ্ট্য নয়—তা পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনের গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন। কলেম্বোলার রঞ্জকতা অনেক সময় সূর্যালোকের বিকিরণ থেকে সুরক্ষা দেয় বা ছত্রাকজনিত সংক্রমণ ঠেকাতে সাহায্য করে। বনভূমির মাটির গভীর ছায়ায় রঙের এই বৈচিত্র্য তাদের খাদ্যাভ্যাস ও বাসস্থলের ভিন্নতারও নির্দেশক।
বৈচিত্র্যময় গঠন, চোখের সংখ্যা, লোম বা সিটাইয়ের বিন্যাস এবং দেহের আকার থেকে স্পষ্ট যে প্যারানুরা গণের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে বিচ্ছিন্ন বিবর্তন ঘটেছে। মৃত কাঠের আর্দ্রতা, ক্ষয়স্তর এবং স্থানের তাপমাত্রার পার্থক্য এসব অভিযোজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
এই স্প্রিংটেইলগুলোর অধিকাংশই ‘স্যাপ্রোক্সিলিক’, অর্থাৎ নষ্ট কাঠের ওপর নির্ভরশীল। মার্কিন ফরেস্ট সার্ভিসের এক গবেষণায় দেখা গেছে, নষ্ট কাঠ কমে গেলে স্যাপ্রোক্সিলিক প্রাণীর সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পায়, যা বনজ জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় সমস্যা।
নমুনাগুলো সংগ্রহের পর ‘বার্লেস ফানেল’ নামের বিশেষ যন্ত্রে শুকিয়ে পৃথক করা হয়। ২০২২ সালের ২৭ নভেম্বর সুশিমা দ্বীপের চিরসবুজ বনের পাতা-জমা স্তর থেকে প্রথম নীল প্রজাতিটি বেরিয়ে আসে। পরে এগুলোকে ইথানলে সংরক্ষণ করা হয় এবং মাইক্রোস্কোপের নিচে স্লাইডে বসিয়ে বিশদ বিশ্লেষণ করা হয়।
এই নতুন আবিষ্কার জাপানের ক্ষুদ্র বনজ প্রাণীবৈচিত্র্য সম্পর্কে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে এবং পরিবেশগত বিবর্তন কীভাবে অতি ক্ষুদ্র প্রাণীদের মধ্যেও বৈচিত্র্য গড়ে তোলে তা নতুন করে তুলে ধরেছে।
