আজকাল ওয়েবডেস্ক:  শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষ পূর্ণিমার দিকে তাকিয়ে ভেবেছে এটি কি সত্যিই মানুষের আচরণ, মেজাজ বা স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে? অনিদ্রা, হঠাৎ মেজাজের পরিবর্তন, কিংবা লোককথায় ওয়্যারউলফ ও “লুনাটিক”-এর গল্প। চাঁদকে বরাবরই অস্বাভাবিক ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু এর কতটা মিথ আর আধুনিক বিজ্ঞান আসলে কী বলে—চাঁদ আমাদের শরীর ও মনের উপর কী প্রভাব ফেলে?


ঐতিহাসিকভাবে চিকিৎসক ও দার্শনিকরা চাঁদের সঙ্গে আচরণগত পরিবর্তনের যোগসূত্র টেনেছেন। ব্রিটিশ বিচারপতি উইলিয়াম ব্ল্যাকস্টোন একসময় বলেছিলেন, মানসিক অবস্থা চাঁদের পর্যায়ের সাথে ওঠানামা করতে পারে। প্রাচীন গ্রিস ও রোমের সভ্যতাও এ ধরনের বিশ্বাস লিপিবদ্ধ করেছিল, যেখানে চাঁদের গতিবিধি, স্বাস্থ্য ও আবেগের সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে।

আরও পড়ুন:  মাসে এক হাজার টাকা বিনিয়োগ করেই পেতে পারেন ২ লাখ টাকা, কীভাবে দেখে নিন এখনই


মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আর্নল্ড লিবার ১৯৭০-এর দশকে এক তত্ত্ব দিয়েছিলেন, যেখানে তিনি বলেছিলেন...
ঘুম ও পূর্ণিমা:
পূর্ণিমা ঘুমকে সূক্ষ্মভাবে প্রভাবিত করতে পারে। গ্রামীণ ও আদিবাসী সম্প্রদায়, এমনকি শহুরে এলাকাতেও দেখা গেছে পূর্ণিমার আগে রাতগুলোতে মানুষ দেরিতে ঘুমোতে যায় এবং তুলনামূলকভাবে কম ঘুমোয়। গবেষকরা মনে করেন, এটি এক ধরনের বিবর্তনজনিত অভিযোজন, যাতে মানুষ উজ্জ্বল চাঁদের আলোতে বেশি সময় সক্রিয় থাকতে পারে। পূর্ণিমার সময় প্রাকৃতিক আলোর পরিমাণ বাড়লেও এর প্রভাব সীমিত।


সার্কাডিয়ান রিদম ও মানসিক স্বাস্থ্য:
আমাদের শরীরের সার্কাডিয়ান রিদম ঘুম, হরমোন নিঃসরণ এবং সার্বিক স্বাস্থ্যের নিয়ন্ত্রণ করে। এই তাল কেটে গেলে উদ্বেগ, হতাশা ও বাইপোলার ডিসঅর্ডারের মতো সমস্যার প্রকোপ বাড়তে পারে। ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের মনোবিজ্ঞানী সুসান আলবার্স জানিয়েছেন, পূর্ণিমা নিয়ে যে মেজাজের ওঠানামা বা মানসিক রোগীদের ভর্তি বেড়ে যাওয়ার গল্প শোনা যায়, তার পক্ষে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।


২০১৯ সালের এক গবেষণায় প্রায় ১৮,০০০ মেডিক্যাল রেকর্ড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চাঁদের পর্যায় ও স্বাস্থ্যের অবনতি বা রোগভোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক নেই।


শরীরের শারীরবৃত্তীয় প্রভাব:
চাঁদের মহাকর্ষীয় টান মানুষের হৃদযন্ত্রের উপর প্রভাব ফেলে কি না—তা নিয়েও গবেষণা হয়েছে। টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে হৃৎস্পন্দন ও রক্তে শর্করার হালকা ওঠানামা দেখা গেলেও রক্তচাপের উপর নিয়মিত কোনও প্রভাব পাওয়া যায়নি। প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়েও অনেকে গবেষণা করেছেন। কিছু ক্ষেত্রে ঋতুচক্র চাঁদের পর্যায়ের সঙ্গে মিলে গেলেও বৃহৎ গবেষণায় এর ধারাবাহিক কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।


মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ও ধারণা:
ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক বলছে, চাঁদের প্রভাব বলে যে অভিজ্ঞতা অনেকে বর্ণনা করেন, তার অনেকটাই আসলে জ্ঞানগত পক্ষপাতের ফল। যেমন কেউ যদি বিশ্বাস করেন যে পূর্ণিমায় তিনি বেশি রাগান্বিত হবেন, তাহলে সেই প্রত্যাশা থেকেই তার আচরণ বদলাতে পারে। ফলে চাঁদের প্রভাব আছে বলে মনে হলেও আসলে সেটি হয় মনস্তাত্ত্বিক কারণে।


লোককথা ও ঐতিহাসিক বিবরণ দীর্ঘদিন ধরে চাঁদের সঙ্গে মানব আচরণের সম্পর্কের কথা বলে এসেছে। কিন্তু আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা যায় চাঁদের সরাসরি প্রভাব খুব সীমিত। আর অনেক ক্ষেত্রে মানুষের বিশ্বাস, প্রত্যাশা এবং মনস্তাত্ত্বিক কারণেই এই প্রভাবকে বেশি মনে হয়।