আজকাল ওয়েবডেস্ক: বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলীয় দাহিয়ায় ২৩ নভেম্বর রাতে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান থেকে চালানো হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো একটি আবাসিক ভবন। হামলায় নিহত হন হিজবুল্লাহর চিফ অব স্টাফ হায়সম তাবতাবাই, যিনি সাইয়্যেদ আবু আলি নামেও পরিচিত। তাঁর সঙ্গে নিহত হয়েছেন সংগঠনের আরও চার সদস্য—মুস্তাফা বেরো, রিফাত হোসেইন, কাজেম বারজাওয়ি এবং ইব্রাহিম হোসেইন। এই হত্যাকাণ্ডকে পশ্চিম এশিয়ার চলমান সংঘর্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সূক্ষ্ম সামরিক অভিযানের একটি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
হায়সম তাবতাবাইকে ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার কারণ ছিল তাঁর দীর্ঘদিনের সামরিক অভিজ্ঞতা এবং নেতৃত্ব। ১৯৮২ সালে হিজবুল্লাহ প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের কেন্দ্রে ছিলেন। দক্ষিণ লেবাননকে ২০০০ সালে ইসরায়েলি দখল থেকে মুক্ত করার লড়াই হোক বা ২০০৬ সালের যুদ্ধে কৌশলগত হামলা—তাবতাবাই ছিলেন সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মুখগুলির একজন। বিশেষ করে হিজবুল্লাহর সবচেয়ে দক্ষ এবং সীমান্ত অভিযানে ব্যবহৃত অভিজাত বাহিনী রাদওয়ান ফোর্স তৈরিতে তাঁর ভূমিকাই তাঁকে ইসরায়েলের চোখে বিপজ্জনক নেতায় পরিণত করে।
শুধু লেবানন নয়, সিরিয়া, ইয়েমেন এবং প্যালেস্টাইনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর যোদ্ধা প্রশিক্ষণ এবং সমন্বয়ের ক্ষেত্রেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে তাঁকে “অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স”-এর অন্যতম স্থপতি হিসেবে দেখা হয়। গত দুই বছরে ইসরায়েলের ধারাবাহিক আক্রমণে হিজবুল্লাহর সামরিক সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তাবতাবাই নীরবে সেই সক্ষমতা পুনর্গঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন—এমন ধারণাই গোয়েন্দা পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছিল। তাই তাঁর নির্মূলকে ইসরায়েল তার প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার কৌশলগত সাফল্য হিসেবে গণ্য করছে।
আরও একটি আলোচিত দিক হলো—২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাবতাবাইকে নিয়ে তথ্য দেওয়ার বিনিময়ে ৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। হামলার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সরকারি ভাষণে সেই বাউন্টির কথা উল্লেখ করেন, যা এই অভিযানের উদ্দেশ্য নিয়ে বিতর্ক আরও বাড়িয়েছে।
হিজবুল্লাহ এক বিবৃতিতে তাবতাবাইকে “মহান জিহাদি কমান্ডার” হিসেবে স্মরণ করেছে এবং জানিয়েছে, তাঁর 'শাহাদাত' সংগঠনের সংগ্রামকে আরও শক্তিশালী করবে। তাঁদের ভাষায়—“এই রক্ত প্রতিরোধের শপথকে আরও দৃঢ় করবে।” শেষ যাত্রায় হিজবুল্লাহর নেতা শেখ আলি দাআমুশ সতর্কবার্তা দিয়ে বলেন—“জায়োনিস্টরা বড় ভুল করেছে।”
প্যালেস্টাইনি ইসলামিক জিহাদের আল-কুদস ব্রিগেডস তাঁকে “লেবাননের প্রতিরোধের স্তম্ভ” উল্লেখ করে শোক জানায়। হামাসও তাঁর ভূমিকাকে “অমূল্য অবদান” বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ সংগঠন জানায়, তাঁর সংগ্রাম প্রতিরোধশক্তিকে আরও অনুপ্রাণিত করবে এবং “এই রক্ত বৃথা যাবে না।”
ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (IRGC) এই হত্যাকে “সন্ত্রাসী অপরাধ” বলে নিন্দা জানিয়ে প্রতিশোধের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। তাদের বক্তব্য—“সময় এলে প্রতিক্রিয়া কঠোর হবে। এই হামলা শক্তির প্রমাণ নয়, এটি ইসরায়েলের ভয়ের বহিঃপ্রকাশ।”
এ হত্যাকাণ্ডে স্পষ্ট যে, পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি আরও অস্থিরতার দিকে এগোচ্ছে। সীমান্ত, সমুদ্রপথ, এবং আঞ্চলিক প্রতিরোধ অক্ষ—সব ক্ষেত্রেই সংঘর্ষের মাত্রা বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাবতাবাইয়ের মৃত্যু শুধু একজন সামরিক নেতার হত্যাকাণ্ড নয়—এটি আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে।
