আজকাল ওয়েবডেস্ক: গাজায় ফের নেমে এসেছে রক্তক্ষয়ী সহিংসতার ছায়া। শুক্রবার গাজা সিটির তুফ্ফাহ এলাকায় বাস্তুচ্যুত প্যালেস্তিনীয়দের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত একটি স্কুল ভবনে ইসরায়েলি ট্যাঙ্কের গোলাবর্ষণে অন্তত ছয়জন নিহত এবং আরও কয়েকজন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে মহিলা ও শিশু থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে। হামলার সময় স্কুলটিতে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান চলছিল বলে জানিয়েছে স্থানীয় সূত্র। আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্যাঙ্কের গোলা সরাসরি ভবনের দ্বিতীয় তলায় আঘাত হানে, মুহূর্তের মধ্যেই উৎসবের পরিবেশ রূপ নেয় শোক ও আর্তনাদে।
গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় অক্টোবর মাসে ঘোষিত যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ইসরায়েল এ পর্যন্ত কয়েকশবার চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। সর্বশেষ এই হামলাকে তারা যুদ্ধবিরতির আরেকটি গুরুতর লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেছে।
এই রক্তক্ষয়ী ঘটনার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার মিয়ামিতে গাজা যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ নিয়ে উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক আলোচনা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের উদ্যোগে আয়োজিত এই বৈঠকে কাতার, মিশর, তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর শীর্ষ প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও'ও আলোচনায় যুক্ত হতে পারেন বলে জানিয়েছেন।
মার্কো রুবিও সাংবাদিকদের বলেন, ওয়াশিংটনের মূল লক্ষ্য হল যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা। এই ধাপে গাজার জন্য একটি প্যালেস্তিনীয় প্রশাসনিক কমিটি গঠন, বিদেশি তত্ত্বাবধানে ‘বোর্ড অব পিস’ প্রতিষ্ঠা এবং আন্তর্জাতিক পুলিশি বাহিনী মোতায়েনের বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে নয় এবং প্রথম ধাপ সম্পন্ন হলেই আন্তর্জাতিক তহবিল পাওয়া সম্ভব হবে, যা মানবিক সহায়তা ও পুনর্গঠনের পথ প্রশস্ত করবে এবং চুক্তির পরবর্তী ধাপগুলো বাস্তবায়নের সুযোগ তৈরি করবে।
অ্যাক্সিওসের তথ্য অনুযায়ী, আলোচনায় অংশ নিয়েছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মহম্মদ বিন আবদুর রহমান আল থানি, তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান এবং মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদর আবদেলআত্তি। একই সময়ে ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু একটি সীমিত নিরাপত্তা বৈঠক ডেকেছেন, যেখানে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ এবং সম্ভাব্য সামরিক বিকল্প নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। হামাসকে নিরস্ত্র করতে ফের অভিযান চালানোর সম্ভাবনার কথাও আলোচনায় উঠেছে, যদিও যুক্তরাষ্ট্র এই মুহূর্তে গাজায় উত্তেজনা বাড়াতে অনিচ্ছুক বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকার দাবি সত্ত্বেও ১০ অক্টোবরের পর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলা কার্যত থামেনি। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের পূর্বাঞ্চলে বিমান হামলা, গোলাবর্ষণ ও ভারী গুলিবর্ষণের খবর পাওয়া গেছে। খান ইউনিসের বানী সুহেইলা এলাকায় গোলাবর্ষণ হয়েছে, যা তথাকথিত ‘ইয়েলো লাইন’-এর ভেতরে- যে এলাকা থেকে যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী ইসরায়েলের সেনা প্রত্যাহারের কথা ছিল। আল-আকসা টিভির খবরে বলা হয়েছে, এসব হামলায় অন্তত তিনজন প্যালেস্তিনীয়দের নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে একজন মহিলা।
এছাড়া গাজার উপকূলে মাছ ধরার নৌকায় ইসরায়েলি নৌবাহিনীর গুলিবর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে। কেন্দ্রীয় গাজার দেইর এল-বালাহ এবং গাজা সিটির শুজাইয়া এলাকায় হামলার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত বসতিগুলোর ওপর ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে দেখা যায়।
এই পরিস্থিতিতে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য বাসেম নাইম বলেছেন, মিয়ামির আলোচনার মাধ্যমে ইসরায়েলের চলমান ‘আইনবহির্ভূত আচরণ’ বন্ধ হওয়া উচিত। তিনি বলেন, গাজার জনগণ আশা করছে এই আলোচনা যুদ্ধবিরতির সব লঙ্ঘন বন্ধ করবে, রাফাহ সীমান্ত উভয় দিকে খুলে দেবে এবং মানবিক সহায়তার নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ নিশ্চিত করবে। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা, পুনর্গঠন এবং প্যালেস্তিনীয় স্বশাসনের পথ খুলে দেওয়ার ওপরও তিনি জোর দেন।
এর আগে কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মহম্মদ বিন আবদুর রহমান আল থানি সতর্ক করে বলেন, ইসরায়েলের লাগাতার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন পুরো শান্তি প্রক্রিয়াকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে এবং মধ্যস্থতাকারীদের অবস্থানকে ক্রমশ জটিল করে তুলছে।
মিয়ামিতে যখন কূটনৈতিক তৎপরতা চলমান, তখন গাজা অবরুদ্ধ। প্রাণহানি, ধ্বংসস্তূপে পরিণত বসতবাড়ি এবং শান্তির অনিশ্চিত প্রতীক্ষায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই ভূখণ্ডে স্থায়ী শান্তি ও পুনর্গঠনের আশায় এখন বিশ্ব তাকিয়ে রয়েছে এই আলোচনার ফলাফলের দিকে।
