আর কে দাস (প্রাক্তন বায়ুসেনা কর্তা)
যত দিন আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে এই গোলাগুলি চলবে তত দিন আর কিছু হোক না হোক, কাশ্মীরে গোলমাল অনেকটাই কম হবে। কারণ, পাকিস্তান এই মুহূর্তে তাদের নিজেদের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত আর সেকারণেই অন্য দেশে সন্ত্রাসে মদত দিতে পারবে না।
এবার আসা যাক আসল কথায়। দুই দেশের মাঝে যে ডুরান্ড লাইন ঘেঁসে এই লড়াই চলছে সেই লাইন ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ কূটনীতিক মর্টিমার ডুরান্ড তৈরি করেছিলেন। তাঁর নামেই দুই দেশের সীমানা নির্ধারণকারী এই লাইনের নামকরণ করা হয়েছে। পাশতুন এবং বালোচ-এর মধ্য দিয়ে যাওয়া এই সীমানা সেইসময় ব্রিটিশশাসিত ভারতকে রাশিয়ার থেকে রক্ষার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। ব্রিটিশ যখন চলে গেল তখন পাকিস্তান এই লাইনকে তাদের পশ্চিম প্রান্তের সীমানা বলে মেনে নিলেও আফগানিস্তান কিন্তু এটাকে সেভাবে মান্যতা দেয়নি।
এই একটা সীমানাই বদলে দিল পাশতুন এবং বালোচদের ভাগ্য। এর আগে তারা কিন্তু আফগানিস্তানের চোখে কখনও 'বিদেশি' হিসেবে ছিল না। বরং ওই এলাকাগুলো ছিল আফগানদের কাছে তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ভাষার একটা বর্ধিত এলাকা। আজও আফগানরা মনে করেন ডুরান্ড লাইন তাঁদের ব্যক্তিস্বত্তায় আঘাত হেনেছে। এই একই ক্ষত দগদগ করছে বালোচদের বুকেও।
এই সীমান্তে একটা উত্তেজনা সবসময় রয়ে গিয়েছে। বর্তমানে এই পরিস্থিতিতে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান, দুই তরফেরই দাবি গত সপ্তাহে যে সংঘর্ষ হয়েছে তাতে তারা ১০০-র কাছাকাছি শত্রু সৈন্যকে হত্যা করেছে এবং আহত করেছে প্রায় একই সংখ্যক সৈন্য। গত শনিবারের পর আফগানিস্তান জানিয়েছে তারা ডুরান্ড লাইন বরাবর পাকিস্তানের একাধিক সেনা চৌকি দখল করেছে। যদিও দু'দেশের মধ্যে এই গোলমাল পুরনো। পাকিস্তানের অভিযোগ, কাবুলের মদতেই তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) আফগানিস্তানে বসে পাকিস্তানে নাশকতা চালাচ্ছে। জবাবে কাবুলের পাল্টা অভিযোগ, কয়েক দশক ধরে পাকিস্তান তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। যার মধ্যে আল-কায়দার মতো সংগঠনকে সহায়তা করার সঙ্গে রয়েছে ২০০১ সালের পর যে সরকার তৈরি হয়েছে তাকে পাকিস্তানের মর্জিমাফিক চলার চেষ্টা করা। যেটা আফগানিস্তানে সমস্যা জিইয়ে রাখছে।
আরও পড়ুন: পাকিস্তান থেকে লাখে লাখে গাধা কিনে চলেছে চীন, এত চারপেয়ে দিয়ে কী করবে শি জিনপিংয়ের দেশ
এমনিতেই পাকিস্তানের মধ্যেই চলছে নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য লড়াই। যার একটি হল বালোচিস্তানে এবং অন্যটি হল খাইবার পাখতুনখোয়াতে। যেখানকার অধিবাসীরা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে চলেছেন। এদের মধ্যে বালোচিস্তানে বালোচ লিবারেশন আর্মি বা বিএলএ এবং এর সঙ্গে থাকা অন্য সংগঠনগুলি কয়েক দশক ধরে তাদের এলাকার মূল্যবান খনিজ সম্পদ রক্ষায় লড়াই করছে। তারা মূলত পাকিস্তানের পরিকাঠামো এবং সেনা লক্ষ্য করে তাদের আক্রমণ হানছে। অন্যদিকে খাইবার পাখতুনখোয়ায় স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে বৃহৎ পাশতুনিস্তান তাদের লক্ষ্য। মনে রাখতে হবে ডুরান্ড লাইন কিন্তু কয়েক লক্ষ পাশতুনকে তাদের আগের জায়গা থেকে আলাদা করে দিয়েছে।
পাকিস্তানের ভিতরে অস্থিরাবস্থা ঠিক কতখানি পৌঁছেছে তার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল পাকিস্তান তার নিজের দেশের মধ্যেই বিদ্রোহ দমনের জন্য বোমা ফেলেছে। সেইসঙ্গে গত সপ্তাহের শেষের দিকে আফগানিস্তানের ভিতরে তারা মিজাইল ফেলেছে। তাদের দাবি, জঙ্গি বিনাশ করতেই এই অভিযান চালানো হয়েছে। যেটা আফগান শাসকদের চোখে তাঁদের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ। পাল্টা জবাবে আফগানরা পাকিস্তান সীমান্তে হামলা চালিয়েছে। ধংস করে দিয়েছে পাকিস্তান সেনার বেশ কয়েকটি চৌকি। এই সংঘর্ষ সীমান্তের বেশ কিছু জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে।
আসলে সীমান্ত সমস্যার সমাধানে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সরিয়ে রেখে গোটা বিষয়টি পরিচালনা করে সেই দেশের সেনাবাহিনী। বিশেষ করে পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের জন্য যে নীতি নির্ধারণ করা হয় তার পুরোটাই করে ওই দেশের পাঞ্জাবি জেনারেলরা। যেখানে গুরুত্ব দেওয়া হয় না স্থানীয় অধিবাসীদের মতামতের। যতদিন না পর্যন্ত পাকিস্তান বালোচিস্তান, খাইবার পাখতুনখোয়া বা আফগান সীমান্তকে মানবিক দৃষ্টিকোণের বদলে স্রেফ একটি উত্তেজনাপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে দেখবে ততদিন পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান তারা করতে পারবে না। এক্ষেত্রে তাদের আমলা বা সেনা সকলের দৃষ্টিভঙ্গি এক।
পরিশেষে একটা কথা আমি আবার বলতে চাই যে গোলাগুলি চলুক বা রক্ত ঝরুক এটা কখনোই কাম্য নয়। কিন্তু এটাও পাশাপাশি মনে রাখতে হবে পাকিস্তানের ভিতরে বা অন্য দেশের সঙ্গে তাদের সীমান্ত সংঘর্ষে কিন্তু তাদের বাধ্য করবে পরের ঝামেলাকে উস্কানি দেওয়া বন্ধ করে নিজেদের ঘর সামলাতে।
