আজকাল ওয়েবডেস্ক: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও নাৎসি গণহত্যার মূল পরিকল্পনাকারী অ্যাডলফ হিটলার যার সিদ্ধান্তে পৃথিবীতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় লক্ষ লক্ষ মানুষ, আজও ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মধ্যে তীব্র বিতর্কের বিষয়। প্রশ্ন একটাই: এই এই ভয়ানক মতবাদের উৎস কোথায়? কীভাবে একজন ব্যক্তি এমন নিষ্ঠুরতা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই সাম্প্রতিক বছরগুলিতে হিটলারের রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি তাঁর ব্যক্তিগত ও যৌন জীবন নিয়েও বিস্তর আলোচনা শুরু হয়েছে। কয়েক বছর আগে CrimeMagazine.com-এ প্রকাশিত ‘The Real Adolf Hitler’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ বিপুল সাড়া ফেলে। লেখকের দাবি অনুযায়ী, গবেষণার সময় তিনি হিটলারের জীবন সম্পর্কে এমন বহু তথ্য পান, যা প্রচলিত ইতিহাসে খুব কমই আলোচিত হয়েছে। বিশেষ করে হিটলারের যৌনতা, সম্পর্ক এবং মানসিক গঠনের দিকটি নতুন করে আলোচনায় আসে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, হিটলারের শৈশব কেটেছিল ভয় ও নির্যাতনের মধ্যে। তাঁর বাবা অ্যালয়িস হিটলার ছিলেন মদ্যপ ও নিষ্ঠুর, যিনি প্রায়ই বেল্ট ও চাবুক দিয়ে ছেলেকে মারধর করতেন। অন্যদিকে মা ক্লারা ছিলেন কোমল স্বভাবের এবং ছেলেকে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। হিটলার পরবর্তী জীবনে মায়ের প্রতি গভীর অনুরাগের কথা বললেও বাবার প্রসঙ্গ প্রায় সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছেন। তাঁর শৈশব স্মৃতিতে মায়ের সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমোনোর উল্লেখ মনোবিশ্লেষকদের কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে বিবেচিত।

এই লেখক ও কয়েকজন গবেষকের দাবি অনুযায়ী, হিটলারের যৌবনের বড় একটি অংশ কেটেছিল পুরুষসঙ্গীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে। ভিয়েনা ও মিউনিখের বস্তি এলাকায় দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকালে একাধিক পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে তাঁর সহাবস্থানের কথা উঠে এসেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর জীবনকে তিনি ‘গৌরবময় পুরুষ সমাজ’ বলে বর্ণনা করেন, যা পরবর্তী গবেষণায় নতুন করে ব্যাখ্যার দাবি রাখে। এমনকি কিছু মার্কিন গোয়েন্দা নথিতে তাঁর যৌনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে বলেও দাবি করা হয়, যদিও এসব তথ্যের ঐতিহাসিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

১৯৩০-এর দশকে নাৎসি পার্টির শীর্ষ স্তরে যৌনতা ও নৈতিকতা নিয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি রাজনৈতিকভাবে হিটলারের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে নাৎসি নেতা আর্নস্ট রোম-সহ বহু গুপ্তচর বাহিনী সদস্যকে হত্যা বা গ্রেপ্তার করা হয় ১৯৩৪ সালের ‘নাইট অব দ্য লং নাইভস’-এ। সরকারি ব্যাখ্যায় এটিকে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র দমনের পদক্ষেপ বলা হলেও সমালোচকেরা একে ক্ষমতা ধরে রাখা ও ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি রক্ষার নির্মম কৌশল হিসেবে দেখেন।

মহিলাদের সঙ্গে হিটলারের সম্পর্কগুলিও ছিল অস্বাভাবিক ও ট্র্যাজিক। তাঁর ভাগ্নি গেলি রাউবালের আত্মহত্যা, অভিনেত্রী রেনাতে মুলারের মৃত্যু, ব্রিটিশ ইউনিটি মিটফোর্ডের আত্মঘাতী চেষ্টা- এসব ঘটনায় হিটলারের ভূমিকা নিয়ে আজও প্রশ্ন রয়ে গেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়ানো একাধিক মহিলা  আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন বা প্রাণ হারিয়েছিলেন। যদিও এসব দাবির অনেকটাই ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ ও পরবর্তী সাক্ষাৎকারনির্ভর, তাই ঐতিহাসিক মহলে এগুলির প্রামাণ্যতা নিয়ে মতভেদ রয়েছে।

সবশেষে ছিলেন ইভা ব্রাউন, হিটলারের দীর্ঘদিনের সঙ্গিনী। সম্পর্কের বহু বছর পর ১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাসে বার্লিনের বাঙ্কারে তাঁকে বিয়ে করেন হিটলার। মাত্র ৪০ ঘণ্টা পর দু’জনেই আত্মহত্যা করেন। এই দৃশ্য নাৎসি শাসনের পতনের প্রতীক হয়ে ইতিহাসে চিহ্নিত।

ইতিহাসবিদদের একাংশ স্পষ্ট করে জানাচ্ছেন, হিটলারের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এইসব আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা দিয়ে ফ্যাসিবাদ, গণহত্যা ও রাষ্ট্রসন্ত্রাসের মতো অপরাধের পূর্ণ ব্যাখ্যা করা যায় না। ব্যক্তিগত বিকারগ্রস্ততা, রাজনৈতিক সুযোগ, অর্থনৈতিক সংকট ও সমাজের সম্মিলিত ব্যর্থতাই মিলিত হয়ে এমন এক ভয়াবহ অধ্যায় তৈরি করেছিল।

হিটলারকে ঘিরে কৌতূহল আজও শেষ হয়নি। তবে ইতিহাসের শিক্ষা একটাই, ব্যক্তিগত জীবনের বিতর্ক যতই আলোচিত হোক না কেন, মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের দায় কোনোভাবেই আড়াল করা যায় না।