আজকাল ওয়েবডেস্ক: ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাতের অভিযোগে বৃহস্পতিবার রাতে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ শহরে একদল জনতার হাতে গণপিটুনির শিকার হন ২৫ বছরের হিন্দু যুবক দীপু চন্দ্র দাস। এই ঘটনা ঘিরে শোরগোল পড়ে য়ায়। জানা গিয়েছে, দীপু ময়মনসিংহে বসবাস করতেন এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য স্থানীয় এক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। তিনি শহরের স্কয়ার মাস্টারবাড়ি এলাকার পাইওনিয়ার নিট কম্পোজিট ফ্যাক্টরির শ্রমিক ছিলেন।

ঘটনার পর বাংলাদেশের বাংলা সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি 'বার্তা বাজার' স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কতা বলেছিলেন। সেই বিবরণ অনুসারে, অভিযোগটি (ধর্মীয় অবমাননা) কারখানার ভেতরে এবং আশেপাশের এলাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পরে একদল ক্ষুব্ধ জনতা দীপু চন্দ্র দাসকে আক্রমণ করে এবং তাঁকে নির্মমভাবে মারধর করে। জানা গিয়েছে, এই আক্রমণের ফলেই ঘটনাস্থলেই ওই যুবকের মৃত্যু হয়।

ভালুকা মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুল মালেক জানান, হত্যার পর জনতা দাসের মরদেহ ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে ফেলে রেখে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফলে রাস্তার উভয় পাশের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

বাবার মুখে ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা
এনডিটিভি-র প্রতিনিধি দীপু চন্দ্র দাসের বাবা রবিলাল দাসের সঙ্গে কথা বলেছিল। তিনি জানান, পরিবার প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে মর্মান্তিক ঘটনাটি জানতে পারে। এনডিটিভিকে গণপিটুনির ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে দীপুর বাবা রবিলাল দাস বলেন, "আমরা ফেসবুকে দেখেছি। ফেসবুক থেকেই আমরা ঘটনাটি শুনতে শুরু করি, তারপর আরও অনেকে বলতে শুরু করে - তারপর আমরা জানতে পারি যখন একজন আমাকে বলল, আমার ভাই...আমার ভাইকে মারধর করা হয়েছে, খুব খারাপভাবে মারধর করা হয়েছে। তারপর আধা ঘণ্টা পর আমার কাকা এসে আমাকে বললেন যে, ওরা আমার ছেলেকে নিয়ে গিয়েছে... ওরা ছেলেটাকে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে।"

নিহত দীপুর শোকার্ত বাবা বলেন, এরপর উত্তেজিত জনতা তাঁর ছেলের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। রবিলাল দাস বলেন, "ছেলেটার পোড়া দেহ বাইরে ফেলে রাখা হয়েছিল। ওরা ওর বুক এবং মাথা একসঙ্গে বাইরে বেঁধে রেখেছিল। এটা ভয়াবহ।" 

সরকারের পক্ষ থেকে গণপিটুনির নিন্দা
শুক্রবার জারি করা এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এই গণপিটুনির নিন্দা করেছে। এই ঘৃণ্য কাজর বাংলাদেশ সরকার বরদাস্ত  করবে না বলেও জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, "নতুন বাংলাদেশে এ ধরনের হিংসার কোনও স্থান নেই। এই জঘন্য অপরাধের হোতাদের রেহাই দেওয়া হবে না।"

তবে নডিটিভি-কে রবিলাল দাস বলেছেন, পরিবার এখন পর্যন্ত কোনও সরাসরি আশ্বাস পায়নি। তাঁর কথায়, "সরকারের পক্ষ থেকে কেউ কোনও ধরনের আশ্বাস দেননি। কেউ কিছুই বলেননি।" 

গণপিটুনির ঘটনায় ৭ জন গ্রেপ্তার
র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) দীপু চন্দ্র দাসকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এক্স-এ এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে যে, র‍্যাব-১৪ বিভিন্ন স্থানে ধারাবাহিক অভিযানের পর এই গ্রেপ্তারগুলো করেছে।

সন্দেহভাজনদের পরিচয় হল-  লিমন সরকার (১৯),  তারেক হোসেন (১৯),  মানিক মিয়া (২০), এরশাদ আলি, নিজাউদ্দিন, আলমগীর হোসেন (৩৮) এবং মিরাজ হোসেন আকন (৪৬)।

ভারতীয় রাজনীতিকদের প্রতিক্রিয়া
কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভঢরা, "মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধকে" যেকোনও সভ্য সমাজের জন্য একটি কলঙ্ক বলে নিন্দা করেছেন, অন্যদিকে অন্ধ্রপ্রদেশের উপ-মুখ্যমন্ত্রী পবন কল্যাণ দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্কের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

এক্স-এ একটি পোস্টে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী লিখেছেন, "বাংলাদেশে উত্তেজিত জনতার হাতে হিন্দু যুবক দীপু চন্দ্র দাসের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর অত্যন্ত উদ্বেগজনক। যেকোনও সভ্য সমাজে ধর্ম, জাতি বা পরিচয়ের ভিত্তিতে বৈষম্য, সহিংসতা এবং হত্যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।"

অন্ধ্রপ্রদেশের উপমুখ্যমন্ত্রী পবন কল্যাণ এক্স-এ লিখেছেন, "ইতিহাস আত্মত্যাগকে স্মরণে রাখে। কিন্তু আজ, যে মাটি একসময় ভারতীয় রক্তে স্বাধীন হয়েছিল, সেই মাটিই নিরীহ সংখ্যালঘুদের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে। ১৯৭১ সালে আমাদের ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়িয়েছিল।"

তিনি আরও বলেন, "আমাদের সাহসী সৈন্যরা শুধু একটি যুদ্ধই লড়েনি; তারা এখনকার বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের পরিচয় ও মর্যাদার জন্য লড়াই করেছিল। বাংলাদেশের জন্ম নিশ্চিত করতে প্রায় ৩,৯০০ ভারতীয় সৈন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এবং ১০,০০০-এরও বেশি আহত হয়েছিলেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়েছিলাম যাতে অন্যরা শান্তিতে বাঁচতে পারে।"