আজকাল ওয়েবডেস্ক: পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর (পিওকে) ফের অশান্ত। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে যে অঞ্চলে হিংসা বিক্ষোভে প্রাণ হারিয়েছিল এক ডজনেরও বেশি মানুষ, সেখানে আবারও বিক্ষোভের আগুন জ্বলছে। এবার রাস্তায় নেমেছে তরুণ প্রজন্ম— জেন জেড, মূলত ছাত্রছাত্রী ও তরুণ শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা সংস্কার এবং বাড়তি ফি-র প্রতিবাদ থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন এখন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে রূপ নিয়েছে।
শিক্ষার প্রশ্নে শুরু, সরকার বিরোধী রূপে বিস্তার
বিক্ষোভের সূত্রপাত মুজাফ্ফরাবাদের অন্যতম প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো হয়েছে এবং পরিকাঠামোগত সুবিধার অভাব চরমে। প্রাথমিকভাবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হলেও, গত সপ্তাহে এক অজ্ঞাত বন্দুকধারী ছাত্রদের ওপর গুলি চালালে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ওই ঘটনায় একজন আহত হয়। ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়, যেখানে দেখা যায় পুলিশের উপস্থিতিতেই গুলিবর্ষণ হচ্ছে। তবে ভিডিওটির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
এই ঘটনাই বিক্ষোভের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীরা টায়ার জ্বালিয়ে, রাস্তায় আগুন লাগিয়ে এবং সরকারি ভবনে ভাঙচুর চালিয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। “শাহবাজ শরিফ সরকার হায় হায়” স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে মুজাফ্ফরাবাদ শহর। পরিস্থিতি ক্রমে ২০২৪ সালের নেপাল ও বাংলাদেশের তরুণদের বিক্ষোভের প্রতিচ্ছবির মতো হয়ে উঠছে।
ই-মার্কিং সিস্টেমে ক্ষোভ
এই বছরের অক্টোবরের শেষে পিওকে-র ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়, যা ছয় মাস বিলম্বে আসে। ফলাফল প্রকাশের পর থেকেই ছাত্রদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। অনেক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন, নতুন ই-মার্কিং বা ডিজিটাল মূল্যায়ন পদ্ধতির কারণে তাদের নম্বর অস্বাভাবিকভাবে কম এসেছে। এমনকি কেউ কেউ জানিয়েছেন, যেসব বিষয়ে তারা পরীক্ষা দেননি, তাতেও তাদের ‘পাশ’ দেখানো হয়েছে।
মিরপুর শিক্ষা বোর্ড ইতিমধ্যেই ই-মার্কিং পদ্ধতি খতিয়ে দেখার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। পাশাপাশি, শিক্ষার্থীরা পুনর্মূল্যায়ন ফি মকুবের দাবিও তুলেছে। বর্তমানে পুনর্মূল্যায়নের জন্য প্রতি বিষয়ে ১,৫০০ টাকা ফি ধার্য করা হয়েছে। অর্থাৎ সাতটি বিষয়ের পুনর্মূল্যায়নের জন্য এক শিক্ষার্থীকে দিতে হচ্ছে প্রায় ১০,৫০০ টাকা। এই দাবিকে ঘিরে পিওকে ছাড়াও লাহোরের মতো শহরেও ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। গত মাসে লাহোর প্রেস ক্লাবের সামনে শিক্ষার্থীদের অবস্থান বিক্ষোভ তারই প্রমাণ।
পুরনো ক্ষোভের পুনর্জাগরণ
এই প্রথম নয়— ২০২৪ সালের জানুয়ারিতেও পিওকে-তে শিক্ষা ফি এবং বেতন বৃদ্ধি নিয়ে বিক্ষোভ হয়েছিল। তখন শুধু ছাত্রছাত্রী নয়, শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মীরাও সেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এবারও একই অসন্তোষ আবার মাথা তুলেছে, তবে এবার নেতৃত্বে তরুণ প্রজন্ম।
তরুণদের অভিযোগ শুধু শিক্ষাব্যবস্থায় সীমাবদ্ধ নয়। তারা বলছে, পিওকে-তে ভগ্নদশা পরিকাঠামো, খারাপ স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং দুর্বল পরিবহন পরিষেবাই তাদের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
জেএএসি-র সমর্থন ও পুরনো রক্তাক্ত ইতিহাস
এই আন্দোলনের পেছনে শক্তিশালী ভূমিকা নিচ্ছে জয়েন্ট আওয়ামি অ্যাকশন কমিটি (JAAC)— যে সংগঠন অক্টোবর মাসে হওয়া সহিংস আন্দোলনেরও নেতৃত্ব দিয়েছিল। সেই সময় ট্যাক্স ছাড়, আটা ও বিদ্যুতে ভর্তুকি এবং অসমাপ্ত উন্নয়ন প্রকল্প সম্পূর্ণ করার মতো ৩০ দফা দাবিতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। পুলিশের গুলিতে অন্তত ১২ জন নাগরিক নিহত হয়। শেষপর্যন্ত শাহবাজ শরিফ সরকারকে প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে চুক্তি করে কিছু দাবি মানতে বাধ্য হতে হয়েছিল।
দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ বিদ্রোহের প্রতিধ্বনি
নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক যুব আন্দোলনের মতোই পিওকে-র পরিস্থিতিও এক গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে। নেপালে যেমন সামাজিক মাধ্যম নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে শুরু হওয়া প্রতিবাদ শেষ পর্যন্ত কেপি শর্মা ওলি সরকারের পতন ডেকে এনেছিল, তেমনই বাংলাদেশে ২০২৪ সালের তরুণ-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে।
শ্রীলঙ্কাতেও ২০২২ সালে যুব সমাজের ক্ষোভ রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। তাই পিওকে-তে এই নতুন তরুণ বিক্ষোভ পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন শাহবাজ শরিফ ও সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের জন্য এক নতুন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পিওকে-র এই নতুন জেন জেড বিদ্রোহ এখনো কোন পথে যাবে তা স্পষ্ট নয়। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই তরুণ প্রজন্মের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক চেতনা ও সরকারের প্রতি হতাশা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার ওপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে। সংক্ষেপে, শিক্ষার প্রশ্নে শুরু হলেও, পিওকে-র বিক্ষোভ আজ পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থার প্রতি এক প্রজন্মের ক্ষোভের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
