আজকাল ওয়েবডেস্ক: আমরা সাধারণত পরজীবীদের ভাবি আধুনিক জীবনের এক বিরক্তিকর ঝামেলা হিসেবে — ব্যাকটেরিয়া, ক্ষুদ্র পোকা বা কৃমি, যারা আজকের প্রাণজগতে নানা সমস্যা সৃষ্টি করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, বিজ্ঞানীরা এখন এমন এক পরজীবীর সন্ধান পেয়েছেন, যে প্রায় অর্ধ বিলিয়ন বছর আগে থেকেই নিজের ‘কৌশল’ চালিয়ে আসছে।
সম্প্রতি একদল গবেষক মরক্কোর প্রাচীন জীবাশ্ম অধ্যয়ন করতে গিয়ে এই অবাক করা প্রমাণ পেয়েছেন। তারা মূলত ৪৮০ মিলিয়ন বছর আগের সাগরজীবনের জীবাশ্ম পরীক্ষা করছিলেন, যেখানে অর্ডোভিশিয়ান যুগের সামুদ্রিক প্রাণীরা চুনাপাথরের স্তরে অসাধারণভাবে সংরক্ষিত রয়েছে।
গবেষণার সময় তারা কিছু অদ্ভুত চিহ্ন খুঁজে পান—ছোট ছোট প্রশ্নবোধকের মতো দাগ, যা সেই জীবাশ্মিত খোলসের উপর ও ভিতরে খোদাই করা ছিল। প্রথমে কেউই বুঝতে পারেননি এগুলো কী। কিন্তু দ্রুত বোঝা গেল, এই চিহ্নগুলো নিছক দৈব নয়; একেকটি খোলসে সাত-আটটি দাগ একই রকমভাবে ছিল, যা নির্দেশ দিচ্ছিল কোনো জীবন্ত প্রাণীর কাজের দিকে।
এরপরই রহস্যের জট খুলতে শুরু করে। বিজ্ঞানীরা খেয়াল করলেন, এই চিহ্নগুলোর নকশা আজকের সমুদ্রের এক পরিচিত প্রাণীর কাজের সঙ্গেই মিলে যায়—এক ধরনের নরমদেহী সামুদ্রিক কৃমি, যাকে স্পিওনিড বলা হয়।
এই স্পিওনিড কৃমিগুলো আধুনিক সাগরেও সক্রিয়। তারা ঝিনুক, মাশেল ও অয়েস্টারের মতো দ্বিকবচী প্রাণীর খোলসে বসবাস করে। মাংস নয়, তারা আক্রমণ করে খোলসটিকেই—তাতে ছোট গর্ত করে নিজেদের আঁকড়ে ধরে। “এরা আসলে অয়েস্টারের শরীর খায় না, বরং তাদের খোলস ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে অয়েস্টারের মৃত্যুহার বেড়ে যায়,” বলেন ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, রিভারসাইড-এর প্যালিওবায়োলজিস্ট কারমা নাংলু, যিনি এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন।
এই ক্ষতি সামান্য মনে হলেও এর প্রভাব বিশাল—বিশেষ করে বাণিজ্যিক অয়েস্টার চাষে। খোলস দুর্বল হয়ে গেলে অয়েস্টার সহজেই মারা যায়, এবং আজও এই একই পরজীবী বিশ্বজুড়ে অয়েস্টার ফার্মে আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছে।
গবেষণায় ব্যবহৃত জীবাশ্মগুলো ছিল আধুনিক ক্লামের এক প্রাচীন পূর্বপুরুষের। অর্ডোভিশিয়ান যুগ ছিল এমন এক সময়, যখন সমুদ্রজীবনের প্রতিযোগিতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। শিকারি প্রাণীর উদ্ভব হচ্ছিল, অনেক প্রাণী সাঁতার ও শিকার করতে শিখছিল, এবং সেইসঙ্গে পরজীবীতার উত্থান ঘটছিল।
অধিকাংশ জীবাশ্ম গবেষণায় কেবল বাইরের গঠন দেখা যায়। কিন্তু এবার গবেষকরা ব্যবহার করেছেন ‘মাইক্রো-সিটি স্ক্যান’ নামের এক উন্নত প্রযুক্তি, যা চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সিটি স্ক্যানের আরও শক্তিশালী সংস্করণ। এটি শিলার ভেতরেও দেখতে পারে, কোনো ক্ষতি না করেই।
এই স্ক্যানের মাধ্যমেই বিজ্ঞানীরা আরও কিছু লুকিয়ে থাকা খোলস ও তার ভেতরে থাকা প্রশ্নবোধক আকৃতির দাগ আবিষ্কার করেন। স্ক্যানের ফলাফলে দেখা যায়, কৃমিগুলো লার্ভা অবস্থায় খোলসের উপর বসে সামান্য অংশ দ্রবীভূত করে নিজেদের স্থাপন করত। পরে বড় হতে হতে তারা খোলসের গভীরে ঢুকে বাঁকা সুড়ঙ্গ তৈরি করত—যার আকৃতি হুবহু প্রশ্নচিহ্নের মতো। কোনো অন্য প্রাণী এমন দাগ রাখে না।
সহ-গবেষক হাভিয়ের ওর্তেগা-হারনান্দেজ, হার্ভার্ডের মিউজিয়াম অফ কম্পারেটিভ জুলজির কিউরেটর, বলেন, “এই অদ্ভুত প্রশ্নচিহ্নের মতো চিহ্নগুলো আমাদের কৌতূহলে রাখত। উত্তর পেতে অনেক সময় লেগেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরনো গবেষণাপত্র ঘেঁটে আমরা ‘ইউরেকা মুহূর্তে’ পৌঁছাই।”
এই আবিষ্কার প্রমাণ করছে—পরজীবিতা কোনো আধুনিক ঘটনা নয়, বরং এটি পৃথিবীর জীবনের সূচনালগ্ন থেকেই বিবর্তনের অংশ ছিল।
