আজকাল ওয়েবডেস্ক: ওয়াশিংটন ডিসিতে আয়োজিত ‘ইউএস-সৌদি ইনভেস্টমেন্ট ফোরাম’-এ টেসলা সিইও এলন মাস্ক জানিয়েছেন, আগামী ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যেই মানব সমাজ এমন এক যুগে পৌঁছাবে, যেখানে কাজ করা বাধ্যতামূলক নয়, বরং ইচ্ছা থেকে করা হবে। মাস্কের ভাষায়, কাজ তখন হবে খেলাধুলা বা ভিডিও গেম খেলার মতো—এক ধরনের শখ।

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, যেমন কেউ দোকান থেকে সবজি কিনতে পারে আবার কেউ শখ করে বাড়ির পেছনে সবজি চাষ করে—ভবিষ্যতে কাজও তেমনই হবে। প্রযুক্তি ও রোবোটিক বিপ্লবের ফলে মানব শ্রম আর অপরিহার্য থাকবে না।

মাস্ক দাবি করেন, ভবিষ্যতের অর্থনীতি পরিচালিত হবে লক্ষ লক্ষ রোবটের উৎপাদনক্ষমতা দিয়ে। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে টেসলার ভবিষ্যৎ মূল্যমানের প্রায় ৮০ শতাংশ আসবে তাদের তৈরি হিউম্যানয়েড রোবট ‘অপটিমাস’ থেকে—যদিও এ প্রকল্পে এখনো বারবার বিলম্ব হচ্ছে।

মাস্কের কল্পিত ভবিষ্যৎ: টাকা বিহীন সমাজ ও ‘ইউনিভার্সাল হাই ইনকাম’

মাস্ক বলেন, উন্নত রোবোটিকস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করবে যেখানে অর্থের ধারণাটিই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে। তিনি লেখক আইয়ান এম. ব্যাংকসের Culture সিরিজের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে প্রযুক্তি-নির্ভর এক "post-scarcity" সমাজে মানুষ চাকরি ছাড়াই জীবন যাপন করে।

ভবিষ্যতে মানুষ যাতে অর্থনৈতিক চাপ ছাড়াই বাঁচতে পারে, তার জন্য তিনি "Universal High Income"-এর প্রস্তাব করেন—যদিও এটি কীভাবে কার্যকর হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত বলেননি। ধারণাটি ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম (UBI)-এর কাছাকাছি, যা নিয়ে ওপেনএআই’র প্রধান স্যাম অল্টম্যান আগেই মত দিয়েছেন।

প্রশ্ন, সন্দেহ ও বাস্তবতা: অর্থনীতিবিদদের মূল্যায়ন

অর্থনীতিবিদদের মতে, মাস্কের ভাবনা আকর্ষণীয় হলেও বাস্তবে পৌঁছাতে এখনো অনেক দূর। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ইয়োয়ানা মারিনেস্কুর মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্রুত অগ্রসর হলেও রোবোটিকস প্রযুক্তি এখনো অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সীমিত প্রয়োগযোগ্য।

তিনি জানান, শিল্পবিপ্লব থেকে শুরু করে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যান্ত্রিকীকরণের চেষ্টা চলছে। কিন্তু প্রযুক্তির উন্নয়ন একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে এসে জটিল হয়ে পড়ে—কারণ তখন প্রত্যেকটি অগ্রগতি আগের তুলনায় আরো কঠিন এবং ব্যয়বহুল।

এছাড়া, এআই ব্যবহারের হার এখনো প্রত্যাশিত মাত্রায় পৌঁছায়নি। ইয়েল বাজেট ল্যাব-এর একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে চ্যাটজিপিটির সূচনার পরও বিশ্ব  শ্রমবাজারে কোনও  বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা যায়নি।


অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সামাজিক কাঠামো নিয়ে উদ্বেগ

টেম্পল ইউনিভার্সিটির শ্রম অর্থনীতিবিদ স্যামুয়েল সলোমন বলেন, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের পাশাপাশি রাজনৈতিক কাঠামোও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সম্পদের বণ্টন ন্যায়সংগত না হলে প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতি বৈষম্য আরও বাড়াতে পারে।

বর্তমান পরিস্থিতি ইতিমধ্যে সেই বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে। মার্কিন স্টক মার্কেটে ‘ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন’ নামে পরিচিত বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর আয় প্রত্যাশা বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু বাকি প্রতিষ্ঠাগুলোর ক্ষেত্রে আয় প্রত্যাশা কমছে।

সলোমনের মতে, প্রশ্নটি এখন কেবল প্রযুক্তি নয়—এটা হবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত: "এই আয় কি সবার হবে, নাকি অল্প কিছু মানুষের?"


কাজহীন সমাজ কি সত্যিই কাঙ্ক্ষিত?

অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ আন্তন কোরিনেক বলেন, মানুষের সুখ ও পরিচয়ের একটি বড় উৎস হল কর্মক্ষেত্রে গড়ে ওঠা সম্পর্ক। কাজ যদি বিলুপ্ত হয়, তবে সমাজকে নতুনভাবে ভাবতে হবে মানুষের সামাজিক যোগাযোগ, উদ্দেশ্যবোধ ও মানসিক সুস্থতার বিষয়গুলো।

মাস্ক নিজেও ভবিষ্যৎ মানবজীবনের অর্থ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন— “যদি রোবট ও এআই সবকিছু ভালোভাবে করতে পারে, তবে মানুষের জীবনের অর্থ কী?”

এলন মাস্কের কল্পিত ভবিষ্যৎ এমন এক সমাজ, যেখানে রোবট কাজ করবে, অর্থ অপ্রাসঙ্গিক হবে, আর মানুষ কাজ বেছে নেবে কেবল আনন্দের জন্য। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ভবিষ্যৎ বাস্তবে রূপ নিতে এখনও অনেক বাধা রয়েছে—প্রযুক্তিগত, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক।

স্বপ্ন ও বাস্তবতার এই টানাপোড়েনেই চলছে বিশ্ব শ্রমবাজারের নতুন অধ্যায়ের প্রস্তুতি—এক এমন ভবিষ্যতের, যেখানে কাজ আর মানুষের পরিচয়ের একমাত্র ভিত্তি নাও হতে পারে।