আজকাল ওয়েবডেস্ক: বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ ইউনূসের প্রশাসনের সিদ্ধান্তে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সঙ্গীত ও শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক পদ বাতিলের বিরুদ্ধে ঢাকায় তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বৃহস্পতিবার রাজধানীতে বিক্ষোভে শামিল হন, অভিযোগ তুলেছেন—ইউনূস প্রশাসন মৌলবাদীদের চাপে নতি স্বীকার করেছে, যা “সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ” ছাড়া কিছু নয়।

ইউনূস সরকারের এই সিদ্ধান্ত আসে ইসলামপন্থী সংগঠনগুলির—বিশেষত হেফাজতে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের—চাপে, যারা সঙ্গীত ও শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক নিয়োগকে “অ-ইসলামিক” আখ্যা দিয়ে প্রতিবাদে নেমেছিল। তারা দাবি তুলেছিল, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিল্প-সংস্কৃতির শিক্ষক নয়, বরং ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। সরকারের সংশোধিত বিজ্ঞপ্তিতে শেষ পর্যন্ত সেই চাপেরই প্রতিফলন ঘটেছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রকের মূল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে চারটি সহকারী শিক্ষক পদ ছিল—সাধারণ, ধর্ম, সঙ্গীত ও শারীরিক শিক্ষা। এটি ছিল প্রাথমিক শিক্ষায় সৃজনশীল ও সামগ্রিক বিকাশের দিকে এক অগ্রগতি। কিন্তু পরে বিজ্ঞপ্তি সংশোধন করে নীরবে বাদ দেওয়া হয় সঙ্গীত ও শারীরিক শিক্ষার পদদ্বয়। সরকারের মুখপাত্র মাসুদ আখতার খান বলেন, “এই দু’টি বিষয়ের শিক্ষক সংখ্যা কম হওয়ায় কার্যকর ফল আসবে না।”

কিন্তু সমালোচকরা এই যুক্তি মানছেন না। তাঁদের মতে, সরকারের এই পদক্ষেপ সরাসরি ইসলামী লবির কাছে আত্মসমর্পণ। ঢাকা ট্রিবিউন জানিয়েছে, সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরই প্রতিবাদে ফেটে পড়ে রাজধানী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত, নাটক ও নৃত্য বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অপরাজেয় বাংলার সামনে জড়ো হয়ে গান, নাট্যাভিনয় ও স্লোগানে প্রতিবাদ জানান। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও স্কাল্পচার স্কোয়ারে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল হয়। তরুণ শিল্পী শায়ান উপস্থিত থেকে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, “ধর্মের বিপরীতে নয়, ধর্মের পাশাপাশি সংস্কৃতি বিকশিত হয়। এই ভ্রান্ত বিভাজনকে প্রতিহত করতে হবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক আজিজুর রহমান তুহিন বলেন, “সভ্যতা টিকে থাকে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর। সঙ্গীত বাদ দিলে শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ব্যাহত হবে।” নাট্যকলা বিভাগের ইসরাফিল শাহীন মন্তব্য করেন, “ধর্ম দিয়ে রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না, সংস্কৃতিই তার প্রাণ।”

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নুসরাত চৌধুরী জাফরিন বলেন, “আমরা চাই প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুরের ধ্বনি উঠুক। এটা কারও ব্যক্তিগত স্বার্থ নয়—এটা জাতির আত্মার দাবি।”

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম মারুফ সরকারের সিদ্ধান্তকে সরাসরি “সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ” বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, “ইউনূস প্রশাসন ক্রমশ বাজারকেন্দ্রিক নীতির দিকে ঝুঁকছে, যা জাতির মেধা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমা চাকমা অভিযোগ করেন, কিছু ছাত্রনেতা জাতীয় সংগীতকেও “অমুসলিম” বলে আখ্যা দিচ্ছেন। তিনি বলেন, “যে সরকার জাতীয় সংগীত ও সংস্কৃতিকে আঘাত করে, তাকে আমি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি।”

এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক গভীর প্রবণতা ফুটে উঠেছে। শেখ হাসিনার পতনের পর সেনাবাহিনী-সমর্থিত অন্তর্বর্তী ইউনূস প্রশাসন বারবার মৌলবাদী সংগঠনগুলির দাবিতে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ থেকে সরে এসেছে। এর আগে নারীর অধিকার সংক্রান্ত সংস্কার পরিকল্পনাতেও সরকার পিছিয়ে গিয়েছিল।

বিশ্লেষকদের মতে, এইসব ঘটনার ফলে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুত্ববাদী পরিচয় মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মুখে। হেফাজতে ইসলামের মতো সংগঠনগুলো এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সাহসী হয়ে উঠেছে।

প্রশ্ন উঠছে—ইউনূস প্রশাসন কি শিশুদের সামগ্রিক শিক্ষার পক্ষে দাঁড়াবে, নাকি ইসলামপন্থীদের ক্রমবর্ধমান চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করবে? বাংলাদেশের প্রগতিশীল নাগরিক সমাজ এখন সেই উত্তর খুঁজছে।