আজকাল ওয়েবডেস্ক: বেঙ্গালুরুর এক ৫৭ বছর বয়সী মহিলাকে প্রায় এক মাস ধরে মানসিকভাবে বন্দি রেখে প্রায় ৩২ কোটি টাকা প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ নামে এই নতুন ধরনের প্রতারণায় একাধিক ব্যক্তি নিজেদের DHL কর্মী, সাইবারক্রাইম দপ্তর, সিবিআই এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (RBI) উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার পরিচয় দিয়ে মহিলাকে ভয় দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়। ঘটনা সামনে আসতেই চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে।

এফআইআর অনুযায়ী, ১৪ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে অভিযোগ দায়ের করেন ভুক্তভোগী। তাঁর দাবি, এই প্রতারণার শুরু ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ। সেদিন তাঁকে ফোন করে একজন নিজেকে DHL-এর কর্মকর্তা বলে জানান যে, মুম্বাইয়ের আন্ধেরি থেকে তাঁর নামে পাঠানো একটি পার্সেলে চারটি পাসপোর্ট, তিনটি ক্রেডিট কার্ড এবং নিষিদ্ধ মাদক এমডিএমএ রয়েছে। মহিলা জানান তিনি মুম্বাই যাননি, কিন্তু প্রতারকেরা বলেন তাঁর পরিচয় কেউ অপব্যবহার করেছে এবং বিষয়টি সাইবার অপরাধ হিসেবে তদন্তে যাচ্ছে।

অল্প সময়ের মধ্যেই ফোনটি ‘সিবিআই’ অফিসারের কাছে ট্রান্সফার করা হয়। তারা মহিলাকে জানান, তাঁর বিরুদ্ধে নাকি শক্ত প্রমাণ রয়েছে এবং যেকোনো সময় তাঁকে গ্রেপ্তার  করা হতে পারে। স্থানীয় পুলিশের কাছে গেলে অপরাধীরা নাকি তাঁর বাড়িতে হামলা চালাতে পারে—এমন ভয়ও দেখানো হয়। পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কে মহিলা প্রতারকদের নির্দেশ মানতে শুরু করেন।

প্রতারকেরা তাঁকে দু’টি স্কাইপ আইডি ইনস্টল করিয়ে নেয়। স্কাইপে এক ব্যক্তি নিজেকে ‘মোহিত হান্ডা’ নামে পরিচয় দিয়ে লাগাতার তাঁর ক্যামেরা চালু রেখে নজরদারি করতে থাকে। তিনি জানান, মহিলা ‘হাউস অ্যারেস্ট’-এ আছেন এবং তাঁকে নিরন্তর পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। দু’দিন পর আরেকজন নিজেকে সিবিআই অফিসার ‘প্রদীপ সিং’ বলে পরিচয় দেয় এবং মহিলাকে ভয় দেখানো, অপমান করা ও গ্রেপ্তারের  হুমকি দেওয়া শুরু করে। মহিলাকে বলা হয়, নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করতে হলে সব সম্পত্তির বিবরণ দিতে হবে।

ভুক্তভোগী জানান, প্রতারকেরা তাঁর ফোনের কার্যকলাপ ও অবস্থান সম্পর্কে জানত, যা তাঁকে আরও আতঙ্কিত করে। তাঁকে বলা হয়, আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (FIU) এবং RBI সম্পত্তি যাচাই করবে। সেই সঙ্গে সাইবারক্রাইম দপ্তরের ভুয়ো চিঠিও দেখানো হয়, যাতে ‘নিতিন পটেল’ নামে ভুয়ো স্বাক্ষর ছিল।

২৪ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ অক্টোবর ২০২৪-এর মধ্যে মহিলা তাঁর সমস্ত ব্যাঙ্ক বিবরণ প্রতারকদের হাতে তুলে দেন। এরপর প্রতারকেরা জানান, তাঁর সব সম্পত্তির ৯০ শতাংশ অর্থ ‘ক্লিয়ারেন্স’-এর জন্য জমা দিতে হবে। চাপের মুখে তিনি তা করেন। পরে আবার তাঁকে ২ কোটি টাকা ‘শিওরিটি’ হিসেবে জমা দিতে বলা হয়। এরপর আরও কয়েক দফা ‘ট্যাক্স’ ও ‘প্রসেসিং ফি’-র নামে টাকা দাবি করা হয়।

এই পুরো সময়টায় স্কাইপের মাধ্যমে তাঁকে প্রতিনিয়ত নজরদারিতে রাখা হয়। ১ ডিসেম্বর তাঁকে একটি ভুয়ো ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট পাঠানো হয়। এরপর তিনি ৬ ডিসেম্বর তাঁর ছেলের বাগদান অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেন। মাসাধিক মানসিক ও শারীরিক চাপের কারণে তিনি দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন বলে জানান।

২০২৫ সালের শুরুতে প্রতারকেরা আবারও টাকা দাবি করে এবং নিশ্চিত করে যে ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব অর্থ ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু একাধিকবার সময় পিছিয়ে দেওয়ার পর ২৬ মার্চ ২০২৫-এ হঠাৎই সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। মোট ১৮৭টি লেনদেনের মাধ্যমে প্রতারকেরা তাঁর কাছ থেকে ৩১.৮৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। পুরো ঘটনা ঘটে ফোন কল এবং লাগাতার অনলাইন নজরদারির মাধ্যমে।

মহিলা জানান, দীর্ঘ মানসিক ট্রমা, অসুস্থতা এবং তাঁর ছেলের ৮ জুনের বিয়ের অনুষ্ঠান পর্যন্ত অপেক্ষা করার জন্য তিনি অভিযোগ দায়ের করতে দেরি করেন। পরিশেষে সুস্থ হয়ে তিনি পুলিশে FIR করেন। পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাটি অত্যন্ত জটিল এবং আন্তঃরাজ্য বা আন্তর্জাতিক প্রতারণা চক্রের সম্ভাবনা রয়েছে। তদন্ত শুরু হয়েছে এবং প্রতারকদের সন্ধানে একাধিক দপ্তর যৌথভাবে কাজ করছে।