আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (VHP) হিন্দু সমাজের উদ্দেশ্যে বড়দিনসহ অন্যান্য অ-হিন্দু ধর্মীয় উৎসব উদযাপন থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। সংগঠনটির দাবি, এই আহ্বানের মূল লক্ষ্য ‘সাংস্কৃতিক সচেতনতা’ বজায় রাখা এবং ধর্ম ও ঐতিহ্যকে রক্ষা করা। এই আবেদন শুধু সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যেই নয় দোকানদার, শপিং মল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকেও লক্ষ্য করে পাঠানো হয়েছে।

১৩ ডিসেম্বর তারিখে লেখা এক চিঠিতে VHP-র ‘ইন্দ্রপ্রস্থ প্রদেশ মন্ত্রী’ সুরেন্দ্র গুপ্ত বলেন, বর্তমান সময়ে হিন্দু সমাজের উচিত সংযম ও মর্যাদার সঙ্গে ধর্মীয় আচরণ করা। চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে দেশের নানা প্রান্তে ‘সংগঠিত ধর্মান্তরকরণের চেষ্টা’ চলছে এবং অন্য ধর্মের উৎসবে অংশগ্রহণ করলে সেই ধর্মগুলির সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে।

এই বিষয়ে দ্য ওয়্যার হিন্দি সুরেন্দ্র গুপ্তকে প্রশ্ন করলে- এই আহ্বান কি ব্যক্তির ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়? তিনি বলেন, “এটা ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্ন নয়, এটা ধর্মান্তরের প্রশ্ন। খ্রিস্টান মিশনারিরা আমাদের সহনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে ধর্মান্তর ঘটায়। এই আহ্বানের উদ্দেশ্য সেই প্রক্রিয়া বন্ধ করা।”

চিঠিতে স্পষ্টভাবে হিন্দুদের বড়দিন কোনওভাবেই উদযাপন না করার আবেদন জানানো হয়েছে। গুপ্ত আরও বলেন, “যারা এখানে এসে ধর্মান্তরের উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের আত্মসমালোচনা করা উচিত। চার্চ যদি প্রকাশ্যে ঘোষণা করে যে ভারতে তারা কোনও ধর্মান্তর করবে না, তাহলে তারা যা খুশি করতে পারে তাতে সমস্যা কোথায়? কিন্তু যদি কেউ ‘হিলিং সার্ভিস’-এর নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ধর্মান্তর ঘটায়, তাহলে সমাজকে রক্ষা করার অধিকার আমাদের নেই কি?”

উল্লেখ্য, ‘হিলিং সার্ভিস’ হল খ্রিস্টান প্রার্থনাসভা, যেগুলির বিরোধিতা দীর্ঘদিন ধরেই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি করে আসছে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, ভারতে খ্রিস্টান জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৭৮ লক্ষ- মোট জনসংখ্যার প্রায় ২.৩ শতাংশ। দিল্লিতে খ্রিস্টানদের সংখ্যা দেড় লক্ষেরও বেশি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহরুখ আলম এই VHP-র আহ্বানকে সংবিধানের ‘ভ্রাতৃত্ব’ (Fraternity) নীতির পরিপন্থী বলে অভিহিত করেছেন। দ্য ওয়্যার হিন্দি-কে তিনি বলেন, “প্রযুক্তিগতভাবে এই ধরনের আবেদন করা সম্ভব হলেও, এটি সংবিধানের মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এটি নিছক মতভেদ বা প্রতিবাদ নয়, বরং সাংস্কৃতিক সীমারেখা টেনে বাদ দেওয়ার রাজনীতি- যা সংবিধানের  প্রস্তাবনার ভ্রাতৃত্বের নীতির বিরোধী।”

তিনি আরও বলেন, “এতে এমন ধারণা তৈরি হয় যে ‘সাংস্কৃতিক সচেতনতা’ মানে বিভিন্ন সংস্কৃতির পারস্পরিক মেলামেশাকে অপবিত্র বলে চিহ্নিত করা। যখন এই ধরনের আহ্বান রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী কোনও সংগঠন থেকে আসে, তখন তা বাস্তব সামাজিক বর্জন সৃষ্টি করে। এর সঙ্গে যদি জোরজবরদস্তি বা নজরদারি-হিংসা যুক্ত হয়, তবে তা স্পষ্টতই অপরাধ।”

আলম সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন ২০১৮ সালের পৃথ্বীরাজ চৌহান বনাম ভারত সরকার মামলা, ২০২২ সালের হিজাব মামলা এবং কাঁওয়ার যাত্রার সময় খাবারের দোকানদারদের ‘নাম যাচাই’ সংক্রান্ত মামলায় ভ্রাতৃত্বের সাংবিধানিক ব্যাখ্যা প্রভৃতি।

VHP দোকান ও ব্যবসায়ীদের ‘হ্যাপি’ বা ‘মেরি ক্রিসমাস’ লেখা সাজসজ্জা নিয়েও আপত্তি তুলেছে। সংগঠনের দাবি, শুধুমাত্র বাণিজ্যিক লাভের জন্য এই ধরনের শুভেচ্ছা জানানো ‘সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তি ও আত্মঅবমাননা’কে উসকে দেয়। তারা ক্রেতাদের এ ধরনের দোকান থেকে কেনাকাটা ‘পুনর্বিবেচনা’ করার আহ্বান জানিয়েছে।

দিল্লি ট্রেড ফেডারেশনের সভাপতি দেবরাজ বাওয়েজা এই আহ্বানে আপত্তি জানাননি। তিনি বলেন, “আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে আমরা গর্বিত। অন্যদের সংস্কৃতি গ্রহণ করার চেয়ে নিজেদেরটাই প্রচার করা উচিত। খ্রিস্টানরা তাদের উৎসব পালন করুন, হিন্দুরা তাদেরটা।”

VHP জানিয়েছে, বড়দিন পালিত হয় এমন শপিং মল ও স্কুলের পরিচালন পর্ষদ ও অধ্যক্ষদের কাছেও এই চিঠি পাঠানো হবে।

সংগঠনটি দাবি করেছে, এই উদ্যোগ কোনও সংঘাত উসকে দেওয়ার জন্য নয়, বরং ‘শান্তিপূর্ণ সাংস্কৃতিক জাগরণ’-এর লক্ষ্যে। তবে সমালোচকদের মতে, ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে সামাজিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের এই চেষ্টা বহুধর্মীয় সমাজে বিভাজন বাড়ায়।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ও বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ শামসুল ইসলাম বলেন, “১৯৯৭ সালে গুজরাটের ডাং জেলায় VHP, বজরং দল ও হিন্দু জাগরণ মঞ্চ প্রথমবার বড়দিন উদযাপনে বাধা দেয়। গির্জা পোড়ানো হয়, খ্রিস্টান স্কুল দখল করা হয়- এই ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না।”

তিনি আরও বলেন, “খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলিতে ভারতীয়রা নির্বিঘ্নে দীপাবলি পালন করেন। শিকাগোতে বিশ্বের বৃহত্তম হিন্দু মন্দির রয়েছে, আবু ধাবিতেও বড় মন্দির আছে- যেখানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ।”

ব্যঙ্গ করে ইসলাম বলেন, “তাহলে কি VHP বলবে- সব ভারতীয় বিদেশ ছেড়ে দেশে ফিরে আসুন, কারণ ওখানে খ্রিস্টানরা থাকে?”

তিনি মনে  করিয়ে দেন, স্বামী বিবেকানন্দ যিশুখ্রিস্টকে মানবতার মুক্তিদাতা হিসেবে দেখেছিলেন এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী নিপীড়নের সমালোচনা করেছিলেন। অথচ RSS ও VHP-র তরফে ১৯২৫ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে কোনও আন্দোলন দেখা যায়নি, এই প্রশ্নের জবাবও সংগঠনগুলির দেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।

২০২৫ সালের ২৯ নভেম্বর, ১৮টি খ্রিস্টান সংগঠনের ডাকে প্রায় ৩,৫০০ খ্রিস্টান সংসদ ভবনের কাছে সমাবেশ করেন। তাঁদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সরকার খ্রিস্টানদের উপর বাড়তে থাকা হিংসা ও বৈষম্য রুখতে ব্যর্থ।

ইউনাইটেড ক্রিশ্চিয়ান ফোরাম (UCF)-এর আহ্বায়ক এ.সি. মাইকেল জানান, “২০১৪ সালে খ্রিস্টানদের উপর হামলার সংখ্যা ছিল ১৩৯। ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৩৪, প্রায় ৫০০ শতাংশ বৃদ্ধি।”

UCF-এর তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে সারা দেশে ৪,৯৫৯টি খ্রিস্টান-বিরোধী ঘটনার নথি রয়েছে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই হুমকি, জোরজবরদস্তি ও হিংসার সঙ্গে ধর্মীয় উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর ভূমিকা দেখা গেছে।

এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে, ‘সাংস্কৃতিক আত্মবিশ্বাস’ কি সত্যিই অন্য ধর্মের প্রকাশ্য উৎসবকে সন্দেহের চোখে দেখার মধ্যেই নিহিত? নাকি এই ধরনের আহ্বান ভারতের সাংবিধানিক বহুত্ববাদ ও ভ্রাতৃত্বের চেতনাকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে?