আজকাল ওয়েবডেস্ক: আরএসএস যে যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষস্থানীয় লবিং ফার্ম স্কোয়ার প্যাটন বগসকে ভাড়া করেছে—এবং যার সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক নিয়েও সম্প্রতি আলোচনা হয়েছে—সে তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর তীব্র সমালোচনা ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। যদিও আরএসএস এই প্রতিবেদন অস্বীকার করেছে, অথচ যুক্তরাষ্ট্রের এলডিএ ফাইলিং, লবিং ডিসক্লোজার ডকুমেন্ট, এবং ৩,৩০,০০০ ডলারের অর্থপ্রদানের নথি এই লবিং চুক্তিকে নিশ্চিত করে। আরএসএস যে এক্স-এ নিজস্ব অ্যাকাউন্ট থেকে ওই লবিস্টদের সঙ্গে তোলা ছবি প্রকাশ করেছে, তা এই অভিযোগকে আরও জোরালো করে তুলেছে।
এই ঘটনাকে ঘিরে সাতটি গুরুতর ও প্রমাণ-সমর্থিত কারণে উদ্বেগ বাড়ছে, এবং তা শুধু রাজনৈতিক optics-এর প্রশ্ন নয়, বরং ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামো, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব, আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি এবং নৈতিকতার প্রশ্নকেও গভীরভাবে নাড়া দিচ্ছে।
প্রথমত, আরএসএসের আর্থিক অস্বচ্ছতা দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্নের মুখে। ভারতীয় আইনে অনিবন্ধিত এই সংগঠন নিজস্ব হিসাব প্রকাশ করে না এবং কর প্রদান করে না—এ কথা ইতিমধ্যেই তাদের পক্ষ থেকে স্বীকার করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল অর্থব্যয়ে লবিং চালানোয় অর্থের উৎস নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে। ভারতের সাধারণ সদস্য বা দাতারা কি এই আন্তর্জাতিক ব্যয়ের বিষয়ে অবগত? সংগঠনের কত অর্থ কোথায় ব্যয় হয়, কারা এর সুবিধাভোগী এবং দেশ বা বিদেশে তাদের নামে কী ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়—এসব কিছুই ভারতীয়রা জানার অধিকার রাখে। এই অস্বচ্ছতা জনবিশ্বাসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং সংগঠনের আন্তর্জাতিক প্রভাব বিস্তারের বৈধতা নিয়েও সন্দেহ তৈরি করে।
দ্বিতীয়ত, এই পদক্ষেপ ভারতের কূটনৈতিক সার্বভৌমত্বকেও দুর্বল করে। বিদেশে ভারতের সরকারের হয়ে কথা বলার দায়িত্ব মূলত পররাষ্ট্র মন্ত্রকেরই। সেখানে দেশের ভেতরের একটি মতাদর্শ-চালিত সংগঠন যখন নিজের উদ্যোগে বিদেশি সরকার ও আইনপ্রণেতাদের কাছে লবিং চালায়, তখন রাষ্ট্রীয় কূটনীতির সঙ্গে তাদের বেসরকারি প্রচেষ্টার বিভাজন অস্পষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে বিদেশি শক্তির কাছে ভুল বার্তা পাঠানো হয়, এবং ভারতের সরকারি অবস্থান ও এক অ-সরকারি মতাদর্শের বক্তব্য গুলিয়ে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতিনির্ধারণে এই দ্বৈত মেসেজিং ভারতের স্থায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতাকেও ক্ষীণ করে।
তৃতীয়ত, আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি বৈচিত্র্যময় ভারতের প্রকৃত চরিত্রকে বিদেশে বিকৃতি ঘটায়। ভারত সংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুত্ববাদী রাষ্ট্র, যেখানে বিভিন্ন ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির সহাবস্থান রয়েছে। কিন্তু আরএসএসের মতাদর্শ, যার সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক হিংসার যোগসূত্র নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলছে, তাকে বিদেশে ভারতের প্রতিনিধিত্বকারী শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হলে, তা ভারতের প্রকৃত সামাজিক বাস্তবতাকে আড়াল করে। ভারতের মুসলমান, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ, নাস্তিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুরা যে ভারতের বৃহত্তর পরিসরের অংশ—তা এই ধরনের লবিং প্রচেষ্টায় হারিয়ে যায়।
চতুর্থত, গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার ক্ষেত্রেও এটি একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা। আরএসএস কোনও নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান নয়, জনগণের কাছে জবাবদিহিতাও নেই, অথচ বিদেশে তারা এমনভাবে লবিং করছে যা ভারতের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে প্রভাবিত করতে পারে। নির্বাচিত সরকার যেখানে দেশের হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, সেখানে একটি সংগঠন ভোটারদের কাছে দায়বদ্ধ না হয়েও বিদেশি নীতি পরিবেশকে প্রভাবিত করতে চাইলে তা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে চলে যায়। বিশ্বব্যাপী যখন ভারতের গণতান্ত্রিক পশ্চাৎগামীতার প্রশ্ন বারবার উঠছে, তখন এমন অস্বচ্ছ লবিং ভারতের ভাবমূর্তিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
পঞ্চমত, বিদেশি প্রভাবের ঝুঁকিও এই ঘটনায় বেড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে লবিং করা মানে কেবল জনসংযোগ নয়, বরং একটি বৃহত্তর বিদেশি প্রভাব স্থাপনের চেষ্টা। আরএসএস-এর আন্তর্জাতিক ইমেজ নিয়ে যেসব মানবাধিকার সংগঠন ও গণমাধ্যম ইতিমধ্যেই সমালোচনামুখর, তারা এই লবিং-এর কারণে আরও তীব্র নজরদারি ও সমালোচনা শুরু করতে পারে। অতীতে দেখা গেছে, এ ধরনের প্রচেষ্টা অনেক সময় উল্টো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যা কূটনৈতিক বিব্রতকর পরিস্থিতির জন্ম দেয়।
ষষ্ঠত, আরএসএসের এই উদ্যোগ একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। যদি একটি সংগঠন বিদেশে লবিং করার পথ খোলে, তবে অন্যান্য সাম্প্রদায়িক, আঞ্চলিক বা এমনকি চরমপন্থী সংগঠনও একই কৌশল অনুসরণ করতে উৎসাহিত হতে পারে। এতে ওয়াশিংটনে প্রভাব-বাণিজ্যের প্রতিযোগিতা শুরু হলে ভারতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বিশেষ করে যদি বিদেশি শক্তি এসব সংগঠনকে ব্যবহার করতে শুরু করে।
সপ্তমত, আরএসএস যে নিজেকে “জাতীয়তাবাদী” সংগঠন হিসেবে তুলে ধরে, তাদের যুক্তরাষ্ট্রে লবিং ফার্ম ভাড়া করা—তার ওপর আবার পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক থাকা সংস্থার কাছে যাওয়া—নিজেদের ঘোষিত মূল্যবোধের সঙ্গেই সাংঘর্ষিক। যে সংগঠন বিদেশি প্রভাবের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নেয়, তাদেরই বিদেশি লবিস্ট নিয়োগ করা পরিষ্কারভাবে বৈপরীত্যের সৃষ্টি করে এবং তাদের আদর্শগত অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
সমগ্র বিবেচনায়, আরএসএসের এই লবিং সিদ্ধান্ত কেবল খারাপ চেহারা তৈরি করে না, বরং গভীরভাবে জাতীয় স্বার্থ, গণতন্ত্র, বৈচিত্র্য ও কূটনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতাকে আঘাত হানে। এক অনিবন্ধিত, মতাদর্শ-চালিত সংগঠন বিদেশের শক্তিধর রাষ্ট্রের নীতি প্রভাবিত করতে অর্থ ব্যয় করলে তা একটি বিপজ্জনক দিকনির্দেশনার সূচনা করে। ভারত রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক কূটনীতি যেখানে স্পষ্ট ও সংবিধানসম্মত, সেখানে আরএসএসের এই পথচলা দেশকে একটি অস্বচ্ছ ও অনিশ্চিত ভূরাজনৈতিক পথে ঠেলে দিতে পারে, যা ভবিষ্যতে ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামো ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে।
