আজকাল ওয়েবডেস্ক: দিল্লির ঐতিহাসিক লালকেল্লা সংলগ্ন এলাকায় হওয়া ভয়াবহ বিস্ফোরণ মামলার তদন্তে এক বড় অগ্রগতি হয়েছে। তদন্তকারী সংস্থাগুলি জানিয়েছে, গ্রেপ্তার হওয়া সন্দেহভাজনদের সঙ্গে তুরস্কের আঙ্কারা থেকে পরিচালিত এক বিদেশি হ্যান্ডলারের যোগসূত্র পাওয়া গিয়েছে। পুলিশের সূত্রে খবর, ওই হ্যান্ডলারের কোডনেম “উকাসা”, যার অর্থ আরবি ভাষায় ‘মাকড়সা’।
তদন্তকারীদের মতে, এই নামটি আসল পরিচয় গোপন করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট হ্যান্ডলারের অবস্থান চিহ্নিত হয়েছে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায়। তিনি ভারতের একাধিক সন্দেহভাজনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন ‘Session’ নামের একটি উচ্চমানের এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপের মাধ্যমে। এই অ্যাপটি ব্যবহারকারীর পরিচয় গোপন রাখতে সক্ষম হওয়ায় নিরাপত্তা সংস্থার নজর এড়াতে এটি ব্যবহার করা হয়েছিল বলে জানা গেছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মূল অভিযুক্ত ড. উমর উন নবী এবং তাঁর সহযোগীরা ওই বিদেশি হ্যান্ডলারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখতেন। তদন্তে উঠে এসেছে যে, ২০২২ সালের মার্চ মাসে ভারতের ফরিদাবাদ অঞ্চলের এক তথাকথিত সন্ত্রাসী মডিউলের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন ব্যক্তি আঙ্কারায় ভ্রমণ করেন। সন্দেহ করা হচ্ছে, ওই সফরের সময়ই তারা “উকাসা”-র সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং বিদেশি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে চরমপন্থী মতাদর্শে প্রভাবিত হন।
এক সিনিয়র তদন্তকারী আধিকারিক জানিয়েছেন, “অভিযুক্তদের ও তাঁদের বিদেশি হ্যান্ডলারের মধ্যে যোগাযোগ কেবলমাত্র Session অ্যাপের মাধ্যমেই হতো। এতে স্পষ্ট যে, পুরো দলটি বিদেশি নির্দেশেই পরিচালিত হচ্ছিল।”
এখন তদন্তকারীরা গ্রেপ্তার হওয়া অভিযুক্তদের ফোন, ল্যাপটপ এবং অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইস থেকে উদ্ধার হওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করছেন। চ্যাট হিস্ট্রি, কল লগ, ও আর্থিক লেনদেনের নথি খতিয়ে দেখা হচ্ছে, যাতে পুরো সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের কাঠামো ও পাকিস্তান-ভিত্তিক গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে সম্ভাব্য যোগসূত্র উন্মোচিত করা যায়।
তদন্তকারীরা মনে করছেন, এই তথ্য হাতে পাওয়ার ফলে তথাকথিত “ডাক্তার মডিউল”-এর কার্যপ্রণালী সম্পর্কে বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে। এই মডিউলটি মূলত শিক্ষিত পেশাজীবীদের দ্বারা গঠিত ছিল, যারা বিদেশি মস্তিষ্কের পরিচালনায় চরমপন্থার পথে পা বাড়িয়েছিল।
এক নিরাপত্তা আধিকারিকের ভাষায়, “এটি শুধুমাত্র একটি স্থানীয় ষড়যন্ত্র নয়; বরং একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের অংশ, যেখানে প্রযুক্তি ও আদর্শ—দু’টিকেই ব্যবহার করা হয়েছে ভারতের মাটিতে অরাজকতা ছড়াতে।”
বর্তমানে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি তুরস্ক ও অন্যান্য পশ্চিম এশীয় দেশের নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে, যাতে আঙ্কারায় অবস্থানরত উকাসা ও তাঁর সহযোগীদের গতিবিধি সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহ করা যায়। তদন্তে নতুন এই সূত্র পাওয়ায় নিরাপত্তা দপ্তরগুলির আশা, রেড ফোর্ট বিস্ফোরণের নেপথ্যে থাকা আন্তর্জাতিক জাল একে একে উন্মোচিত হবে।
একই সঙ্গে দক্ষিণ কাশ্মীরের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে জামাত-ই-ইসলামি কর্মীদের বাড়িতে, ধারাবাহিকভাবে তল্লাশি চালানো হয়েছে। এ সময় গ্রেপ্তার হয় মওলভি ইরফান, যিনি এই চিকিৎসক চক্রটিকে ধর্মীয়ভাবে প্রভাবিত করেছিলেন বলে পুলিশ দাবি করছে।
উমরের পুলওয়ামার কৈল গ্রামের আত্মীয়রা তাঁকে শান্ত, অন্তর্মুখী, বইপ্রেমী এক ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। “ও খুব একটা বাইরে যেত না, নিজের মতো থাকত,” বলেন এক আত্মীয়। তবে পুলিশ বলছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তাঁর আচরণে পরিবর্তন আসে — তিনি প্রায়ই ফরিদাবাদ ও দিল্লির মধ্যে যাতায়াত করতেন এবং রামলিলা ময়দান ও সোনেহরী মসজিদের আশপাশে ঘুরে বেড়াতেন।
বিস্ফোরণের দিন সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, বিকেল ৩টার দিকে উমরকে ওই মসজিদের কাছে গাড়ি পার্ক করতে, তারপর লালকেল্লার দিকে যাত্রা করতে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, তিনি তিন ঘণ্টার মতো সেখানেই অবস্থান করেন। তাঁর নামে নথিভুক্ত একটি লাল ফোর্ড ইকোস্পোর্ট গাড়িও ফরিদাবাদ থেকে উদ্ধার হয়েছে, যার দিল্লির ঠিকানা ভুয়ো বলে প্রমাণিত।
পুলিশ ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সূত্রে আরও জানা গেছে, উমর উন নবী ও মুজাম্মিল গণাই আগে তুরস্ক সফর করেছিলেন, যেখানে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল একাধিক বিদেশি হ্যান্ডলারের। ওই সফরের পর থেকেই তাঁরা একটি টেলিগ্রাম গ্রুপের মাধ্যমে নির্দেশ পাচ্ছিলেন ভারতে হামলার পরিকল্পনা করার জন্য।
সূত্রের দাবি, “ডক্টর মডিউল” নামে পরিচিত এই গোষ্ঠী দীপাবলির সময় জনবহুল এলাকায় হামলার পরিকল্পনা করেছিল, যদিও তা সফল হয়নি। পরে পাকিস্তানে অবস্থানরত জইশ নেতা উমর বিন খত্তাব পরিচালিত একটি টেলিগ্রাম গ্রুপ থেকেই নতুন টার্গেট বেছে নেওয়া হয় বলে সন্দেহ।
একাধিক সংস্থা — দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেল, জম্মু–কাশ্মীর পুলিশ এবং উত্তরপ্রদেশের এটিএস — যৌথভাবে এখন এই “ফরিদাবাদ মডিউল”-এর অন্যান্য সদস্যদের খুঁজে বের করতে তৎপর।
এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “এই নেটওয়ার্কটি উচ্চশিক্ষিত যুবকদের ব্যবহার করে জঙ্গিবাদ ছড়ানোর নতুন রূপরেখা তৈরি করছিল। চিকিৎসকদের মতো পেশাজীবীরা এতে যুক্ত হওয়ায় গোয়েন্দারা বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন।” ঘটনার পর দিল্লি ও সংলগ্ন অঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। লালকেল্লা ও অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থানে বিশেষ টহল শুরু হয়েছে, যাতে কোনও নতুন হামলার আশঙ্কা না থাকে।
এই মর্মান্তিক ঘটনার তদন্তে ইতিমধ্যেই বহু গুরুত্বপূর্ণ সূত্র মিলেছে, তবে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির মতে, “ডক্টর মডিউল”–এর শিকড় আরও গভীরে বিস্তৃত — যা কেবল ভারতে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্কের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
