আজকাল ওয়েবডেস্ক: লোকসভার বিরোধী দলনেতা ও কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী আজ এক সাংবাদিক সম্মেলনে নির্বাচন কমিশনের (ECI) বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ হানলেন। তিনি অভিযোগ করেন, কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির সঙ্গে মিলেমিশে নির্বাচন কমিশন ‘সংবিধানিক বিশ্বাসঘাতকতা’ করছে এবং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে “ভোট চুরি” করে দেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করছে।
“এটা গণতন্ত্রের উপর একটি পারমাণবিক বোমা”- রাহুল
দিল্লির ইন্দিরা ভবনে কংগ্রেস সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রাহুল গান্ধী বলেন, “ভোট চুরি গণতন্ত্রের উপর একটি পারমাণবিক বোমা ফেলেছে।” তিনি হিন্দি ও ইংরেজিতে প্রেজেন্টেশন দিয়ে ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে লক্ষ লক্ষ ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে বিজেপির পক্ষে মোড় ঘোরানো হয়েছে। তিনি কর্ণাটকের বেঙ্গালুরু সেন্ট্রাল লোকসভা কেন্দ্রের মহাদেবপুরা বিধানসভা এলাকা থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য তুলে ধরেন। তাঁর দাবি, ৬.৫ লক্ষ ভোটারের মধ্যে অন্তত ১ লক্ষ ভোট ‘চুরি’ হয়েছে।
৫টি ভোট জালিয়াতির ধরণ চিহ্নিত
রাহুল জানান, কংগ্রেসের ৩০–৪০ জন গবেষকের একটি বিশেষ দল ছয় মাস ধরে মাঠে ও নথিপত্রে কাজ করে পাঁচটি আলাদা আলাদা ভোট জালিয়াতির ধরণ চিহ্নিত করেছে। এই বিশ্লেষণে প্রায় ৭ ফুট উচ্চতার নথিপত্র ব্যবহার করা হয়েছে। পাঁচটি ধরণ নিচে দেওয়া হল:
১. ডুপ্লিকেট ভোটার (একই নাম একাধিকবার): ১১,৯৬৫
২. ভুয়ো/অকার্যকর ঠিকানা: ৪০,০০৯
৩. এক ঠিকানায় বহু ভোটার (বাল্ক ভোটার): ১০,৪৫২
৪. অস্বচ্ছ বা ভুল ফটো: ৪,১৩২
৬. ফর্ম ৬-এর অপব্যবহার (নতুন ভোটার রেজিস্ট্রেশন): ৩৩,৬৯২
একই ব্যক্তি একাধিক জায়গায় ভোটার!
তিনি উল্লেখ করেন, গুরকিরত সিং ডাং নামে এক ব্যক্তি এক নাম ও ঠিকানা নিয়ে চারটি ভিন্ন বুথে ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত। আদিত্য শ্রীবাস্তব নামে অপর ব্যক্তি মহাদেবপুরায় দুটি, মুম্বাইয়ে একটি ও লখনউতেও একটি ভোটার হিসেবে উপস্থিত। বিশাল নামের একজন ব্যক্তি মহাদেবপুরার দুটি বুথ এবং উত্তরপ্রদেশের বারাণসী ক্যান্টনমেন্টেও ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত।
আরও পড়ুন: ভারতীয় পণ্যের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের চড়া শুল্ক: ক্ষতির মুখে কোন কোন পণ্য?
ভুয়ো ঠিকানা ও অস্বাভাবিক ভিড়
রাহুল গান্ধী বলেন, “আমরা এমন ভোটার খুঁজে পেয়েছি যাঁদের ঠিকানা লেখা আছে ‘হাউস নম্বর ০, স্ট্রিট নম্বর ০’। বুথ ৩৬৬-তে ৪৬ জন ভোটার একই ঘরে বসবাস করছেন বলে দেখানো হয়েছে, অথচ বাস্তবে সেই ঘর একটি সিঙ্গল রুম এবং কেউই সেখানে থাকেন না।”
তিনি অভিযোগ করেন, সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে কংগ্রেস কর্মীরা বহুবার শারীরিক হামলার শিকার হয়েছেন।
ফটো ও নামের বিকৃতি
রাহুল গান্ধী এক ৭০ বছর বয়সী মহিলার উদাহরণ দেন — শকুন রানি, যিনি মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে দু’বার ভোটার রেজিস্ট্রেশন করেছেন, এবং ফটোটিকে এমনভাবে বদলানো হয়েছে যাতে দেখে আলাদা ব্যক্তি মনে হয়। তিনি আরও বলেন, অনেক ভোটারের ক্ষেত্রে বাবার নামের জায়গায় অদ্ভুত অক্ষরের সমাহার, অর্থহীন গিবরিশ, এবং এমন ছবি দেওয়া হয়েছে যা চেনার উপায় নেই।
অসম নির্বাচনী ফলাফল: হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ
রাহুল বলেন, ২০২৪ সালের হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস মাত্র ৮টি আসনে হেরে যায়, যেখানে মোট ভোটের ব্যবধান ছিল মাত্র ২২,৭৭৯। অথচ সারা রাজ্যে মোট ভোটার ছিল ২ কোটি। এটা কোনো রাজনৈতিক ঢেউ নয়, বরং পরিসংখ্যানগত ধাক্কা (statistical shock)।
তিনি বলেন, “এই নির্বাচনের ফলাফল শুধু অভূতপূর্ব নয়, অতিবাস্তব। আমাদের অভ্যন্তরীণ সমীক্ষা, এক্সিট পোল ও বাস্তব ফলের মাঝে চরম বিভ্রাট ছিল।”
নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ
রাহুল গান্ধীর বক্তব্য অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন ইচ্ছাকৃতভাবে ইলেকট্রনিক ভোটার তালিকা দিচ্ছে না, যাতে বিরোধীরা সহজে বিশ্লেষণ করতে না পারে। শুধু তাই নয়, CCTV ফুটেজের নিয়মও বদলে দেওয়া হয়েছে, যাতে ভোটের দিনে সিসিটিভি পর্যবেক্ষণ সম্ভব না হয়। তিনি বলেন, “কমিশন বলছে, কাগজের তালিকা দেখো, কিন্তু ডিজিটাল দিচ্ছে না। আমরা তাহলে কীভাবে চেক করব?”
২০২৪ লোকসভা: ২৫টি আসনে ৩৩,০০০-এর কম ব্যবধান
রাহুল গান্ধীর সবচেয়ে বিস্ফোরক দাবি, “বিজেপি মাত্র ২৫টি আসন চুরি করেই ক্ষমতায় আছে। ৩৩ হাজারের কম ব্যবধানে জেতা এই আসনগুলোতে ভোট চুরি করে বিজেপি সরকার গঠন করেছে।”
মহারাষ্ট্রে ১ কোটির বেশি নতুন ভোটার!
তিনি দাবি করেন, “লোকসভা ও বিধানসভা ভোটের মাঝের পাঁচ মাসে মহারাষ্ট্রে ১ কোটি নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছে — যা বিগত ৫ বছরে মোট ভোটার বৃদ্ধির সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এটা স্বাভাবিক নয়, বরং ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত।”
কংগ্রেসের দাবি:
১. মেশিন-রিডেবল (ডিজিটাল) ভোটার তালিকা প্রকাশ
২. ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের CCTV ফুটেজ সংরক্ষণ
৩. নিরপেক্ষ সংস্থার মাধ্যমে ভোটার তালিকার তদন্ত
রাহুল গান্ধীর শেষ কথা ছিল, “আজ আমরা যা তুলে ধরলাম, তা নিঃসন্দেহ, তথ্যভিত্তিক এবং অস্বীকার করা অসম্ভব। যদি গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হয়, তবে এই ভোট চুরি বন্ধ করতেই হবে।” কংগ্রেস ইতিমধ্যেই নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে, তবে এখনও কোনও প্রাসঙ্গিক প্রতিক্রিয়া মেলেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অভিযোগ শুধু ২০২৪ সালের নিরিখে নয়, ভবিষ্যতের নির্বাচন এবং দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন তোলে।
