আজকাল ওয়েবডেস্ক: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বাণিজ্যিক আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘বাই লোকাল’ বা ‘স্থানীয় পণ্যের ব্যবহার’-এর আহ্বান ফের একবার টেলিভিশনের পর্দায় জাতীয়তাবাদী আবেগ উসকে দিয়েছে। তার অনুরণনে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ 'স্বদেশি'র সঙ্গে ‘জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধ’-এর সরাসরি যোগসূত্র টেনে নিয়েছেন। আগস্ট মাসে স্বাধীনতা দিবসের আবহে 'স্বদেশি' শব্দটি সাধারণ ভারতীয়ের মনে গভীর আবেগ জাগায়, কিন্তু বাস্তবতা বলছে — আজকের পৃথিবী ১৯৪০-এর দশকের নয়।

ভারত যতই আত্মনির্ভরতার ভাষণে আত্মবিশ্বাস দেখাক, অত্যাধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে দেশটি এখনও প্রবলভাবে আমদানিনির্ভর। সরকারের নিজস্ব তথ্য অনুযায়ী, দেশে ব্যবহৃত চিকিৎসা যন্ত্রের ৮০%-এর বেশি আমদানি করা হয়। ভারতের বাজার চিকিৎসা যন্ত্রের জন্য বিশ্বের শীর্ষ ২০-এর মধ্যে থাকলেও উৎপাদনে তার অংশ মাত্র ১.৫%। দেশীয় উৎপাদন সীমিত কিছু উচ্চ-পরিমাণ, নিম্ন-মূল্যের পণ্যে—যেমন মাস্ক, গ্লাভস বা ক্যাথেটার।

আরও পড়ুন: এয়ারটেলের নতুন রিচার্জ প্ল্যান: মাত্র ১ টাকায় অতিরিক্ত ১৪ জিবি ডেটা

এই প্রেক্ষাপটে শুধুমাত্র 'স্বদেশি'র ডাকে দেশীয় হাসপাতালগুলো যদি কেবল দেশীয় যন্ত্রপাতি কিনতে শুরু করে, তাহলে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো কার্যত ধসে পড়বে। এমন বিপর্যয়ের ইঙ্গিত মিলেছিল কয়েক বছর আগেই, যখন সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে GeM (Government e-Marketplace) ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশীয় যন্ত্রপাতি কিনতে বলা হয়। এর ফলে গবেষণার মান এবং কার্যকারিতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একাধিক প্রতিষ্ঠানের তীব্র আপত্তির পরে, কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রককে বাধ্য হয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ₹২০০ কোটি পর্যন্ত বৈদেশিক টেন্ডারে অনুমতির ছাড়পত্র দিতে হয়।

২০২২ সালে প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল মেডিক্যাল ডিভাইসেস পলিসি’র লক্ষ্য অনুযায়ী, ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারতকে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি চিকিৎসা যন্ত্র উৎপাদনকারী দেশে পরিণত করার পরিকল্পনা রয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, ২০১৪ সালেই এই খাতে শতভাগ FDI অনুমোদিত হয়েছে। তবু, বহু স্কিম, ‘লোকাল কনটেন্ট’-এর উপর জোর এবং আমলাতান্ত্রিক বাধা এখনও দেশীয় উৎপাদনকে পর্যাপ্ত বেগ দিতে পারেনি।

করোনার সময় ভেন্টিলেটরের হঠাৎ চাহিদা তৈরি হওয়ায় গাড়ি প্রস্তুতকারকসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান এই উৎপাদনে নামে। প্রধানমন্ত্রী কেয়ার্স ফান্ড থেকে অর্থসাহায্যও দেওয়া হয়। তবে বাস্তবে অনেক হাসপাতালেই এই ভেন্টিলেটর বা সময়মতো পৌঁছায়নি, বা সম্পূর্ণরূপে ত্রুটিপূর্ণ ছিল। এমনকি কিছু রাজ্যে এ নিয়ে আদালতের ভর্ৎসনার মুখেও পড়তে হয় সরকার ও প্রস্তুতকারকদের। এই পরিস্থিতি ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ ব্র্যান্ডের উপর প্রশ্নচিহ্ন তোলে।

বিদেশি প্রস্তুতকারকদের কাছে ভারতের ১.৪ বিলিয়ন মানুষের বাজার আকর্ষণীয় হলেও, বাস্তবিক নিয়মনীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বিনিয়োগে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। টেন্ডারে সবচেয়ে কম দরদাতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া, প্রতিটি আমদানি করা যন্ত্রাংশকে স্থানীয় মানদণ্ডে রেজিস্ট্রি করানো এবং 'লোকাল কনটেন্ট' নির্ধারণে সফটওয়্যার ও এআই প্রযুক্তিকে গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়।

সরকার যে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ২%-এরও কম ব্যয় করে, সেটিকে পুষিয়ে দিতে পানীয় জল, স্যানিটেশনসহ অন্যান্য খাতে খরচ ধরা হচ্ছে, যাতে করে বাস্তব ব্যয়কে দ্বিগুণ দেখানো যায়। চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়িয়ে দেখাতে আয়ুর্বেদ বা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদেরও গোনা হচ্ছে। এসব ফাঁপা পরিসংখ্যান আন্তর্জাতিক চিকিৎসা প্রযুক্তি সংস্থাগুলিকে বিভ্রান্ত করবে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।