আজকাল ওয়েবডেস্ক: বেলাগাভিতে অনুষ্ঠিত বিধানসভার অধিবেশনে বিধায়কদের ভোটে বিলটি অনুমোদিত হয়। এই আইনে ঘৃণামূলক অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
বিল অনুযায়ী, প্রকাশ্যে মৌখিক বক্তব্য, লেখা, জনসমক্ষে প্রদর্শন কিংবা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রচারিত যে কোনও বক্তব্য বা কার্যকলাপ, যা কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ, শত্রুতা বা ঘৃণা ছড়ায়, তা এই আইনের আওতায় আসবে। ঘৃণামূলক অপরাধের ক্ষেত্রে ন্যূনতম এক বছরের কারাদণ্ড বাধ্যতামূলক, যা সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত হতে পারে। বারবার অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তি আরও কঠোর- ন্যূনতম দুই বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড এবং জরিমানা এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত।
বিলটি পেশ করার সময় কর্ণাটকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জি. পরমেশ্বর চলতি বছরের ৫ মে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের এক গুরুত্বপূর্ণ রায়ের উল্লেখ করেন। সেই রায়ে শীর্ষ আদালত সাম্প্রদায়িক ঘৃণার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিল। পরমেশ্বর বলেন, “হেট স্পিচ শুধু সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট করে না, বহু ক্ষেত্রে তা খুন ও সম্প্রদায়িক হিংসার পথ প্রশস্ত করেছে।” তাঁর দাবি, ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা কিংবা অন্যান্য পরিচয়ের ভিত্তিতে বৈষম্য ও বিদ্বেষ রুখতেই এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, যা সংবিধানিক মূল্যবোধ রক্ষার জন্য অপরিহার্য।
তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, কেন আলাদা আইন প্রয়োজন। তাঁর কথায়, “প্ররোচনামূলক বক্তৃতা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকলে কাউকে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করা যায়। কিন্তু কতদিন তা করা সম্ভব? তাই একটি স্থায়ী আইন দরকার।” তাঁর মতে, ঘৃণামূলক ভাষণ প্রায়ই হিংসাত্মক ঘটনার জন্ম দেয়, যা আগেভাগে রুখতে আইনি কাঠামো জরুরি।
এই আইনের অধীনে সরকার মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম থেকে ঘৃণামূলক বক্তব্য বা উপাদান সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারবে। জনসমক্ষে বলা কথা, লেখা, পোস্টার-ব্যানার কিংবা ডিজিটাল ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত বিষয়বস্তুও এর আওতায় থাকবে। বিলে ‘হেট ক্রাইম’-এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ, শত্রুতা বা খারাপ ইচ্ছা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে ঘৃণামূলক বক্তব্য তৈরি, প্রকাশ, প্রচার, উসকানি দেওয়া বা তাতে সহায়তা করাও অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
বিলটি ঘৃণামূলক বক্তব্যকে গ্রেপ্তারযোগ্য ও জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই মামলার বিচার হবে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফার্স্ট ক্লাস (JMFC) আদালতে। কোনও সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে, অপরাধের সময় যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের সকলকেই দায়ী বলে গণ্য করা হবে- এমন বিধানও এতে রাখা হয়েছে।
কর্ণাটকের কংগ্রেস সরকার চলতি বছরের জুন মাসেই এই ধরনের আইন নিয়ে আলোচনা শুরু করে। উপকূলীয় কর্ণাটকে একের পর এক সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড, বিশেষ করে এপ্রিল মাসে মুসলিম যুবক আশরাফের গণ-পিটুনির ঘটনার পর এই উদ্যোগ জোরদার হয়।
তবে বিলটির তীব্র বিরোধিতা করেছে বিজেপি। বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা আর. অশোক বিলটির একটি কপি ছিঁড়ে ফেলে প্রতিবাদ জানান। বিজেপি বিধায়করা সভার কক্ষে নেমে এসে বিক্ষোভ দেখান। অশোকের অভিযোগ, এই আইন সংবিধানের ১৯(১) অনুচ্ছেদে দেওয়া মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘন করছে। তাঁর মতে, পুলিশ এই আইনকে রাজনৈতিক স্বার্থে অপব্যবহার করবে। “এটি শাসক দলের হাতে একটি অস্ত্র। কাউকে খুশি করতে অন্য কাউকে জেলে পাঠানো হবে,”-এমন মন্তব্য করেন তিনি। সাংবাদিক ও বিরোধী দলগুলিকেও টার্গেট করা হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন অশোক। তাঁর দাবি, নতুন ভারতীয় ন্যায় সংহিতাতেই উসকানিমূলক বক্তব্য মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট ধারা রয়েছে।
বিতর্ক আরও তীব্র হয় যখন নগর উন্নয়ন ও নগর পরিকল্পনা মন্ত্রী বাইরাথি সুরেশ বিজেপি বিধায়ক বেদব্যাস কামাথ-কে উদ্দেশ্য করে মন্তব্য করেন, “উপকূলে আগুন লাগিয়ে এখন এখানে আগুন ছড়াচ্ছেন কেন?” এই মন্তব্যের পর বিজেপি বিধায়করা তীব্র আপত্তি জানান এবং স্পিকার ইউ. টি. খাদার-এর কাছে মন্তব্যটি কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়ার দাবি করেন।
হট্টগোল চলাকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরমেশ্বর বিধানসভার সদস্যদের বিলটির পক্ষে সমর্থন জানানোর আবেদন করেন। বিরোধীরা তখনও প্রতিবাদে ব্যস্ত থাকায় আলোচনায় আর অংশ নিতে পারেননি। সেই অবস্থায় স্পিকার ঘোষণা করেন যে বিলটি পাশ হয়ে গেছে এবং পরে মধ্যাহ্নভোজের জন্য সভা মুলতবি করা হয়।
পরবর্তীতে বিজেপি বিধায়করা অভিযোগ করেন, তাঁদের অংশগ্রহণ ছাড়াই বিলটি পাশ করানো হয়েছে। আর. অশোক বলেন, “আলোচনা সংক্ষিপ্ত করার কোনও প্রয়োজন ছিল না।” তবে আইনমন্ত্রী এইচ. কে. পাটিল স্পষ্ট জানিয়ে দেন, বিলটি ইতিমধ্যেই পাশ হয়ে গেছে এবং এ নিয়ে আর আলোচনার সুযোগ নেই।
এই বিল কার্যকর হলে কর্ণাটকে ঘৃণামূলক বক্তব্য ও অপরাধ দমনে এক নতুন ও কঠোর আইনি অধ্যায় শুরু হবে, যদিও তা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক আপাতত থামার কোনও লক্ষণ নেই।
