আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিহারে ভোটার আগে ভাষ্য জনপ্রিয় হয়েছিল ‘এনডিএ–ইসিআই জোটের জন্য কি প্রস্তুত INDIA?’ সে সময় বিরোধীরা প্রকাশ্যে তেমন কিছু বলছিল না, কিন্তু শেষ বল পড়ার পরই যেন স্পষ্ট হল, আশঙ্কাটা তারা অন্তরে অনেক আগেই ধারণ করেছিল—এই ম্যাচ হয়তো শুরু থেকেই “ফিক্সড” ছিল।
৫ নভেম্বর দিল্লিতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে, হরিয়ানার ২০২৪ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কথিত ভোট কারচুপির ‘এইচ-ফাইলস’ ফাঁস হওয়ার পর, লোকসভার বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী স্পষ্ট ভাষায় বলেন যে এখন আর এটি বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়, বরং একটি পদ্ধতিগত, শিল্পায়িত নির্বাচন হস্তক্ষেপের মডেল। তাঁর কথায়, “এটা একটা সিস্টেম। ইনস্টিটিউশনালাইজড রিগিং এখন ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজড হয়ে গেছে। যে কোনও রাজ্যে এই মডেল চালানো সম্ভব, আর এটি বিহারে চালানোই হবে। বিহার নির্বাচনের পর আমরা একই ধরনের রেকর্ড দেখাব, যা প্রমাণ করবে যে একই ঘটনা বিহারেও ঘটেছে।”
‘এইচ-ফাইলস’ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না—এর আগে কর্ণাটকের মহাদেবপুরা (লোকসভা ২০২৪) এবং আলন্দ (বিধানসভা ২০২৩) নিয়েও একই রকম দুর্নীতির অভিযোগ সামনে এসেছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সারা রাজ্যে পরিচালিত ইসিআইয়ের বিশেষ নিবিড় পর্যালোচনা (SIR) নিয়ে একের পর এক অনুসন্ধান, যেখানে অ-কর্পোরেট সংবাদমাধ্যম, ইউটিউবার এবং স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের প্রকাশিত রিপোর্ট ভোটার তালিকার সততা ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর গভীর সন্দেহ তৈরি করেছে।
৩ আগস্ট ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সিপিআই(এমএল) সাধারণ সম্পাদক দিপঙ্কর ভট্টাচার্য মন্তব্য করেছিলেন যে SIR মানে আসলে ‘Special Intensive Reconstruction’। তাঁর এই মন্তব্য যে কতটা তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, তা বুঝতে হলে SIR-এর অস্বাভাবিক ও অসঙ্গতিপূর্ণ সংখ্যাগুলো আর একবার দেখা প্রয়োজন। তবে তার আগে আসা যাক ভোটগণনার রাতে দেখা দেওয়া বিস্ময়কর ফলাফলগুলোর কথায়।
গণনার এগারো ঘণ্টা পর দেখা যায়, বিজেপি তাদের লড়া ১০১টি আসনের মধ্যে ৯২টিতে এগিয়ে—অর্থাৎ ৯১ শতাংশের অভাবনীয় স্ট্রাইক রেট। জেডিইউ এগিয়ে ৮৩ আসনে, এলজেপি (রাম বিলাস) এগিয়ে ১৯-এ, হাম এগিয়ে ৫ আসনে এবং আরএলএম ৬টির মধ্যে ৪টিতে। এমনকি ওয়াইসি-র AIMIM-ও ৫টি আসনে এগিয়ে ছিল। সব মিলিয়ে এনডিএ-র ঝুলিতে প্রায় ২০৩টি আসন, আর বিশাল ল্যান্ডস্লাইডের মুখে মহাগঠবন্ধন নেমে এসেছে ৪০-এর ঘরে—যার মধ্যে একাই আরজেডি পেয়েছে ২৬টি।
এই অপ্রত্যাশিত ফল দেখে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুহাস পালশিকার একরকম ব্যঙ্গ করেই বলেন, “যখন কোনও দল ৮০–৯০ শতাংশ আসনে জিততে চলেছে, তখন নির্বাচন বিশ্লেষণের বিষয় হওয়া উচিত—ওরা বাকি ১০–২০ শতাংশে হারল কীভাবে?”
ফলাফলের এই গাণিতিক চিত্র আরেকটি রাজনৈতিক বাস্তবতাকেও সামনে আনে। বিজেপি একাই সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে, যার ফলে নীতীশ কুমারের জেডিইউ-র দরকষাকষির ক্ষমতা প্রায় তলানিতে। এমনকি তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বও অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে। এনডিএ'র জয়ের পর বিজেপি যে তাকে কোনও সময় ‘অপারেশন লোটাস’-এর টার্গেট বানাতে পারে, তা এখন অনেকটাই সম্ভাব্য। আর এটিই হয়তো ছিল বিজেপির পরিকল্পনা—মুখ্যমন্ত্রী পদে আগে থেকে নীতীশকে ঘোষণা না করা।
এখন প্রশ্ন—এই অকল্পনীয় বিজয় কেমন করে তৈরি হল? বিহারের বাস্তব পরিস্থিতি, এনডিএ সরকারের কাজকর্ম বা নীতীশ কুমারের দুই দশকের ‘সুশাসন’—কোনও দিক থেকেই এমন বিপুল জয়ের যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। সর্বোচ্চ দারিদ্র্যের হার, জাতীয় গড়ের দ্বিগুণ বেকারত্ব, দুর্বল স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সূচক—সব মিলিয়ে জনগণের ‘উচ্ছ্বাসে’ এমন ফল আনা অসম্ভব বলেই মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। এমনকি মহিলা ভোটারদের মধ্যেও অসন্তোষ বাড়ছিল—যাঁদের নিয়ে অনেকে মনে করেছিলেন, তাঁরা নীতীশের সবচেয়ে বড় সমর্থক।
এখন আসা যাক SIR-এর সংখ্যাতত্বে—যে সংখ্যাগুলো পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাকেই চ্যালেঞ্জ করে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বিহারের ভোটার সংখ্যা ছিল ৭.৮৯ কোটি। ২৪ জুন হঠাৎ ঘোষিত SIR শুরু হওয়ার আগের সন্ধ্যায় এই সংখ্যাই সরকারি হিসেবে প্রকাশিত ছিল। ১ আগস্ট প্রকাশিত খসড়া তালিকায় ভোটার সংখ্যা নেমে গেল ৭.২৪ কোটিতে—মানে এক লাফে ৬৫ লাখ নাম মুছে গেল। ৩০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত চূড়ান্ত তালিকায় সংখ্যাটি আবার বেড়ে দাঁড়াল ৭.৪২ কোটিতে—মাত্র এক মাসে ২১ লাখ সংযোজন, যার কোনও যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেয়নি কমিশন।
আরও বিস্ময়ের বিষয়—‘দ্বৈত নাম’ বাদ দেওয়ার কথা বলে নাম কাটার যুক্তি দেখালেও, ইসিআই তাদের নিজস্ব ডি-ডুপ্লিকেশন সফটওয়্যারই চালায়নি। ১১ নভেম্বর, নির্বাচনের পরদিন, কমিশন ঘোষণা করল যে চূড়ান্ত তালিকার ৭.৪২ কোটি থেকে বেড়ে ভোটার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭.৪৫ কোটিতে। প্রশ্ন ওঠে—শেষ তালিকা প্রকাশের পর আবার নতুন তিন লক্ষ নাম এল কোথা থেকে?
এতসব পরস্পরবিরোধী তথ্য, রহস্যময় সংযোজন–বিয়োজন এবং অনিয়মের অভিযোগকে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। নতুন আইনের ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের মনোনীত দুই কমিশনারের দাপটে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিয়েও এখন তীব্র বিতর্ক।
এ পরিস্থিতিতে বিরোধীদের প্রশ্ন—এই ম্যান্ডেট কি আদৌ জনগণের? নাকি এটি একটি সুচিন্তিত, সংগঠিত এবং প্রতিষ্ঠানগতভাবে পরিচালিত নির্বাচনী প্রকৌশলের ফল? বিহারের বাস্তব সামাজিক–অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে এনডিএ-র এই ঐতিহাসিক জয়ের কোনও যোগসূত্রই পাওয়া যায় না, আর সেটাই সন্দেহকে আরও প্রবল করে তুলছে যে এই বিজয়—অন্তত কিছু অংশ—গভীরভাবে “ইঞ্জিনিয়ারড”।
