আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভীমা কোরেগাঁও মামলা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। নেদারল্যান্ডসের ডিজিটাল ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ রবার্ট ইয়ান মোরা সম্প্রতি দাবি করেছেন, পুনে পুলিশের ফরেনসিক রিপোর্টে বাজেয়াপ্ত করা একটি পেন ড্রাইভে ম্যালওয়্যার পাওয়া গেলেও তা তদন্তকারী সংস্থার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়নি। ২০২২ সালে ওয়াশিংটন পোস্টের অনুরোধে মামলার ডিজিটাল প্রমাণ খতিয়ে দেখার সময় তাঁর নজরে আসে এই বিষয়টি। তিনি বলেন, রোনা উইলসনের বাজেয়াপ্ত  হওয়া পেন ড্রাইভে থাকা একটি ফাইল VirusTotal–এ পরীক্ষা করার পর দেখা যায়, তা বহু সাইবার সিকিউরিটি সংস্থা NJRAT বা Houdini RAT নামের পরিচিত রিমোট এক্সেস ট্রোজান হিসেবে শনাক্ত করেছে। অথচ পুলিশের রিপোর্টে কোথাও তা ম্যালওয়্যার হিসেবে উল্লেখ নেই। তাঁর কথায়, “এত পরিচিত ম্যালওয়্যার সাধারণ অ্যান্টি ভাইরাসেই ধরা পড়ে, তাই যদি ভারতীয় সংস্থাগুলি সত্যিই স্ক্যান করে থাকে, তাহলে এটা চিহ্নিত না হওয়ার প্রশ্নই ওঠে।”

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মামলার তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে আবার সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এর আগেই ম্যাসাচুসেটস–ভিত্তিক মার্কিন সংস্থা Arsenal Consulting রিপোর্ট দিয়েছিল যে, অভিযুক্তদের কম্পিউটারে দূর থেকে ম্যালওয়্যার ঢুকিয়ে প্রমাণ বসানো হয়েছিল। Amnesty International, Citizen Lab, Sentinel One–এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাও এই মামলায় স্পাইওয়্যার ও রিমোট হ্যাকিং ব্যবহারের অভিযোগ তুলেছে। ভারত সরকার ও জাতীয় তদন্ত সংস্থা (NIA) এসব দাবি অস্বীকার করে বলেছে, তদন্তে এমন কোনো ম্যালওয়্যার পাওয়া যায়নি এবং এসব রিপোর্ট “তথ্য বিকৃতি”।

তবে একাধিক স্বাধীন বিশেষজ্ঞের পর্যালোচনায় একই ধরনের ফল আসায় সংশয় আরও গভীর হয়েছে। মোরা আরও জানান, Arsenal-এর রিপোর্টে যে তথ্য উল্লেখ রয়েছে—স্ট্যান স্বামীর কম্পিউটার থেকে পুলিশের অভিযান আগের রাতে হ্যাকারের কার্যকলাপ মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল—তা তাঁর মতে সবচেয়ে উদ্বেগজনক। কারণ এটি ইঙ্গিত করে, অভিযানের সময় সম্পর্কে হ্যাকার আগেই জানত এবং সেটি কোনো অস্বাভাবিক সমাপতন নয়। তাঁর কথায়, “এটা দেখায় পরিকল্পনা এবং অভিযানের মধ্যে কোনো যোগসূত্র থাকতে পারে।”

এই মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ইউএপিএ (UAPA) অনুযায়ী মামলা চলছে এবং বিচার প্রায় শুরুই হয়নি। রোনা উইলসন ছয় বছরের বেশি সময় জেলে কাটানোর পর ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে জামিন পেয়েছেন। যাঁরা এখনও বন্দী, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মানবাধিকার আইনজীবী সুরেন্দ্র গ্যাডলিং—যিনি সাত বছর ধরে বিচারবিহীন কারাবন্দী। স্ট্যান স্বামী আদালত থেকে জামিন না পেয়ে বন্দী অবস্থাতেই মারা যান। বোম্বে হাই কোর্ট তার রায়ে বলেছে, অনির্দিষ্টকালের জন্য বিচার বিলম্বিত রাখা সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন, অর্থাৎ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলপা শাহ বলেন, “এই মামলা শুধু কিছু কর্মী বা বুদ্ধিজীবীর বিরুদ্ধে নয়—এটি ভারতের গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। যদি এই মামলা আদালতে প্রমাণ সাজানোর উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে তা বিশ্বের যেকোনো গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক সংকেত।” তাঁর মতে, স্বাধীন তদন্ত ছাড়া সত্য প্রকাশ পাবে না।

মোরা সুপারিশ করেছেন যে, আদালত নিজস্ব স্বাধীন ডিজিটাল ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে একই ফরেনসিক ইমেজ পুনরায় পরীক্ষা করুক। তিনি ইন্টারপোলের সঙ্গে কাজ করছেন, যাতে ভবিষ্যতে ডিজিটাল প্রমাণ পরীক্ষা বাধ্যতামূলকভাবে স্বচ্ছ ও যাচাইযোগ্য হয়।

এই মামলার কেন্দ্রে এখন একটাই প্রশ্ন—যেখানে ডিজিটাল প্রমাণের সত্যতা নিয়ে এতগুলি আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিশেষজ্ঞ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, সেখানে এত মানুষ এখনও বিচার না হয়েই কারাগারে রয়েছেন কেন? এই দীর্ঘ কারাবাস কি ন্যায়বিচারের প্রয়াস, নাকি বিচার ব্যবস্থাকে চাপের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা? দেশে–বিদেশে বাড়তে থাকা প্রশ্নের মুখে এখন সবার চোখ আদালতের দিকে—সত্যিকারের বিচার আদৌ হবে কি না।