আজকাল ওয়েবডেস্ক: লাল পতাকা কাঁধে নিয়ে, ঢাক-ঢোলের তালে তালে কয়েকশো শ্রমিক ও কমিউনিস্ট কর্মীর পদযাত্রায়  বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) মুম্বইয়ে পালিত হয়  কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (সিপিআই)-এর শতবর্ষ। দাদরের শ্রমিক ভবন থেকে রেলওয়ে ইনস্টিটিউট পর্যন্ত বিশাল শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে শহরে উদ্‌যাপিত হয় দলের প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর পূর্তি।

লাল শাড়ি ও পোশাকে বিপুল সংখ্যক মহিলা কর্মী-সমর্থক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষ এই মিছিলে অংশ নেন। “সিপিআই জিন্দাবাদ”, “শ্রমিক ঐক্য জিন্দাবাদ” স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে দাদর এলাকা।

১৯২৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া তার শতবর্ষে পা রাখে ২০২৫ সালের একই দিনে। শতাব্দী প্রাচীন এই রাজনৈতিক যাত্রাকে স্মরণ করতেই আয়োজন করা হয় এই মিছিল ও জনসভা।

শোভাযাত্রা শেষে এক বৃহৎ জনসভায় বক্তব্য রাখেন সিপিআই নেতা ও পলিটব্যুরো সদস্য ভালচন্দ্র কঙ্গো এবং বিশিষ্ট শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের নেতা মিলিন্দ রানাডে। বক্তারা দলের ১০০ বছরের সংগ্রামী ইতিহাস, আদর্শগত অবস্থান এবং বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেন।

তাঁরা বিশেষভাবে আজকের ভারতে স্কুল, হাসপাতাল, সরকারি জমি ও আবাসনের ক্রমবর্ধমান বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে পার্টির সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। বক্তারা বলেন, “নয়া উদারনৈতিক আক্রমণের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির ঐক্যই আজ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ও দায়িত্ব।”

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সিপিআই-এর একাধিক বর্ষীয়ান নেতা ও কর্মী, প্রকাশ রেড্ডি, বাবলি রাওয়াত, চারুল যোশী-সহ আরও অনেকে। প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ গোবিন্দ পানসারে ও কৃষ্ণা দেশাইকে মরণোত্তর আজীবন সম্মাননায় সম্মানিত করা হয়।

শতবর্ষ উপলক্ষে মুম্বই জুড়ে সিপিআই-সংযুক্ত শ্রমিক ইউনিয়নগুলির উদ্যোগে ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। ২৬ ডিসেম্বর পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। মুম্বইয়ের সিপিআই সদর দপ্তর ও লালবাগ, দাদর, মালাড-সহ বিভিন্ন পার্টি অফিস সাজানো হয় আলোকসজ্জায়। আগামী দিনগুলিতে একাধিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনও করা হয়েছে।

শতবর্ষের এই উদ্‌যাপন শুধুমাত্র স্মরণ নয়, বরং মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে সিপিআই-এর ভূমিকার পুনর্মূল্যায়নেরও একটি মুহূর্ত হয়ে ওঠে। নেতারা স্মরণ করেন সম্যুক্ত মহারাষ্ট্র আন্দোলনে কমিউনিস্টদের ঐতিহাসিক ভূমিকা।

“মুম্বইসহ মহারাষ্ট্র” দাবিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সম্যুক্ত মহারাষ্ট্র সমিতিতে সিপিআই, কৃষক ও শ্রমিক পার্টি, প্রজা সোশ্যালিস্ট পার্টি ও শিডিউল্ড কাস্ট ফেডারেশনের মতো দলগুলি যুক্ত ছিল। তবে এই আন্দোলনের প্রকৃত শক্তি ছিল মুম্বইয়ের টেক্সটাইল মিল শ্রমিক ও লক্ষ লক্ষ শিল্পশ্রমিক।

কমিউনিস্ট নেতৃত্বে ‘এক সমাজতান্ত্রিক ভারতের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক মহারাষ্ট্র’-এর স্লোগানে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।  এস.এ. ডাঙ্গে, এ.বি. বর্ধন ও গোদাবরী পারুলেকরের নেতৃত্বে লাল পতাকার মিছিল গ্রামে গ্রামে আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দেয়।

১৯৫৫ সালে “মুম্বই মহারাষ্ট্রের” দাবিতে আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে শহিদ হন ১০৫ জন যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন শ্রমিক। দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৯৬০ সালের ১ মে গঠিত হয় মহারাষ্ট্র রাজ্য, যার অন্তর্ভুক্ত হয় মুম্বই।

মহারাষ্ট্র গঠনের পরেও প্রায় ৮৬৫টি মারাঠি-ভাষাভাষী গ্রাম বেলগাম, কারওয়ার, নিপানি, বিদর, ভলকি কর্ণাটকের অন্তর্ভুক্ত থেকে যায়। এই সীমান্ত প্রশ্নে কমিউনিস্ট নেতারাই প্রথম সারিতে থেকে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।

বর্তমান সময়েও ভাষা ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষায় সক্রিয় সিপিআই। রাজ্য পরিচালিত মারাঠি স্কুল বাঁচানোর আন্দোলনে পার্টির ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিসরে ২০১৯ সালে বিজেপি-এনডিএ-র বিরুদ্ধে মহারাষ্ট্র বিকাশ আঘাড়ি (এমভিএ) গঠনে সিপিআই নেতা প্রকাশ রেড্ডির অবদানও স্মরণ করা হয়।

শতবর্ষের উদ্‌যাপন নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বকেও সামনে নিয়ে এসেছে। নাসিকের তালহা শেখ, আহিল্যানগরের সঙ্গমনের দত্ত ধাগে-সহ একাধিক তরুণ নেতা আসন্ন পুরসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁদের কাছে এই শতবর্ষ শুধুই অতীত স্মরণ নয় বরং শ্রমিক শ্রেণির অধিকার ও সামাজিক ন্যায়ের লড়াইকে নতুন করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।

শতবর্ষের এই মুহূর্তে সিপিআই আবারও ঘোষণা করেছে ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্য ও তৃণমূল গণআন্দোলনের পথে থেকেই আগামী দিনের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে তারা।

তথ্য সূত্র: আউটলুক