আজকাল ওয়েবডেস্ক: সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্প বাতিল হওয়ার পর প্রথম পূর্ণ আর্থিক বছরেই দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এক গভীর বৈষম্য যা তুলে ধরেছে দ্যা ওয়্যার। নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জমা দেওয়া ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরের অনুদান সংক্রান্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের তুলনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি অনুদান সংগ্রহ করেছে। শুধু তাই নয়, বিজেপির মোট তহবিল দেশের এক ডজন বিরোধী দলের সম্মিলিত অনুদানের তুলনায়ও ৪.৫ গুণ বেশি।

কমিশনের  তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে বিজেপি যেখানে ৩,৯৬৭ কোটি টাকা অনুদান পেয়েছিল, লোকসভা নির্বাচনের বছরে সেই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়ায় ৬,০৮৮ কোটি টাকায়। এই বিপুল অর্থের বড় অংশই এসেছে কর্পোরেট দুনিয়া থেকে। টাটা গোষ্ঠী, ও.পি. জিন্দাল গ্রুপ, এল অ্যান্ড টি, মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং, অশোক লেল্যান্ড, ডিএলএফ ও মাহিন্দ্রা-এই সাতটি বড় কর্পোরেট হাউস মিলিয়ে ২০২৪-২৫ সালে ইলেক্টোরাল ট্রাস্টগুলিতে মোট ২,১০৭ কোটি টাকা দিয়েছে, যা ট্রাস্টগুলির মোট অনুদানের প্রায় ৫৫ শতাংশ। ওই বছর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে ইলেক্টোরাল ট্রাস্টগুলির মাধ্যমে মোট অনুদানের পরিমাণ ছিল ৩,৮১১.৩৭ কোটি টাকা।

এর ঠিক বিপরীত ছবি ধরা পড়েছে কংগ্রেসের ক্ষেত্রে। ২০২৪-২৫ সালে কংগ্রেস অনুদান, ট্রাস্ট ও গ্রান্ট মিলিয়ে পেয়েছে মাত্র ৫২২.১৩ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবর্ষের (১,১২৯.৬৬ কোটি) তুলনায় অর্ধেকেরও কম। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, কংগ্রেসের মোট অনুদানের ৬০ শতাংশ, অর্থাৎ ৩১৩.৭৬ কোটি টাকা এসেছে ইলেক্টোরাল ট্রাস্ট থেকে। ইলেক্টোরাল বন্ড পরবর্তী যুগে দুই জাতীয় দলের মধ্যে আর্থিক ব্যবধান যে ক্রমশ বেড়েই চলেছে, এই তথ্য তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ)-এর শরিক দলগুলির আর্থিক অবস্থাও একরকম নয়। অন্ধ্রপ্রদেশের ক্ষমতাসীন তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি) ২০২৪-২৫ সালে পেয়েছে ৮৩.০৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরের ১০০.১৮ কোটির তুলনায় কম। টিডিপির সবচেয়ে বড় দাতা ছিল প্রুডেন্ট ইলেক্টোরাল ট্রাস্ট, যারা একাই ৪০ কোটি টাকা দিয়েছে। এছাড়া এ বি জেনারেল ট্রাস্ট (৫ কোটি) ও ট্রায়াম্ফ ট্রাস্ট (৪ কোটি) থেকেও অনুদান এসেছে।

কর্পোরেট দাতাদের মধ্যে ছিল নাটকো ফার্মা (৭ কোটি), ভার্সিটি এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট (৫ কোটি), ক্রিস্টি ফ্রাইডগ্রাম ইন্ডাস্ট্রি (২ কোটি), ইউনাইটেড টেলি লিংকস (২ কোটি) ও প্রিয়া অ্যাকোয়া ফার্মস (২ কোটি)। পাশাপাশি সৌরশক্তি খাতের একাধিক সংস্থা উল্লেখযোগ্য অনুদান দিয়েছে-হেরেম্বা রিনিউএবলস (৫৯.৯০ লক্ষ), নিমুচ সোলার পাওয়ার (৪৩.৮০ লক্ষ), রিনিউ রাঙ্গা রেড্ডি সোলার পাওয়ার (৫৭.৮০ লক্ষ), রিনিউ সোলার এনার্জি (ঝাড়খণ্ড ফাইভ) (২৯.১০ লক্ষ), রিনিউ উইন্ড এনার্জি (রাজস্থান ওয়ান) (৪৩.২০ লক্ষ), শ্রেয়স সোলার ফার্মস (৫২.৫০ লক্ষ) এবং অখিলাগ্যা সোলার এনার্জি (৩০.৬০ লক্ষ)। সেঞ্চুরি প্লাইবোর্ডসও দিয়েছে ৫০ লক্ষ টাকা। ব্যক্তিগত দাতাদের মধ্যে শরৎ বাবু বল্লিনেনি ও কৃষ্ণ মোহন বল্লিনেনি দিয়েছেন ২ কোটি টাকা করে।

টিডিপির রাজ্য সভাপতি পাল্লা শ্রীনিবাস রাও সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা যে এক পয়সাও অনুদান পাই, তার জন্য দাতাদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের একটি স্বাস্থ্য প্রকল্পে আমরা ৩৮ কোটি টাকা খরচ করি, এই সবই অনুদানের অর্থ থেকেই আসে।”

টিডিপির শরিক দল জনসেনা পার্টি (জেএসপি), যার নেতৃত্বে রয়েছেন উপমুখ্যমন্ত্রী পবন কল্যাণ, পেয়েছে ২৫.৩৩ কোটি টাকা। এই দলের অনুদানের বড় অংশ এসেছে ব্যক্তি দাতা ও নির্মাণ সংস্থাগুলির কাছ থেকে। হায়দরাবাদের ব্যক্তি দাতা রাভিকুমার আকুলা দিয়েছেন ৫ কোটি টাকা। আরভিএম কনস্ট্রাকশনস ইন্ডিয়া দিয়েছে ৩ কোটি এবং নাটকো ফার্মা দিয়েছে ১ কোটি টাকা। এছাড়া ডিভিকে কনস্ট্রাকশনস (২ কোটি), সাইনাথ এডিএস (১.৫ কোটি), মিরাকল সফটওয়্যার সিস্টেমস (১ কোটি) ও ব্যক্তি দাতা উদ্দারাজু শ্রী রাম লক্ষ্মীপতি ভোগা রাজু (১ কোটি) উল্লেখযোগ্য অনুদান দিয়েছেন। জেএসপি প্রায় কোনও বড় ইলেক্টোরাল ট্রাস্টের অনুদান পায়নি। দলের মুখপাত্র অজয়া কুমার ভেমুলাপতি জানান, ১০ থেকে ২০ টাকা করে অনুদান দেওয়া তৃণমূল স্তরের  কর্মী ও পেনশনভোগীদের প্রতি দল কৃতজ্ঞ।

আম আদমি পার্টি (আপ) ২০২৪–২৫ সালে অনুদানে প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আগের বছরের ১১.০৬ কোটি টাকা থেকে বেড়ে অনুদানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৮.১ কোটি টাকায়। এর মধ্যে প্রুডেন্ট ইলেক্টোরাল ট্রাস্ট একাই দিয়েছে ১৬.৪ কোটি টাকা, যা মোট অনুদানের ৪৩ শতাংশেরও বেশি। আপের দাতাদের তালিকায় ব্যক্তিগত দাতাদের আধিক্য চোখে পড়ে; শীর্ষ ১০০ দাতার মধ্যে মাত্র চারটি ছিল কোনও সংস্থা। তালাপাডি উমাশঙ্কর শেন দিয়েছেন ৩৭.৭৪ লক্ষ এবং মাইকেল ডি’সুজা দিয়েছেন ৩০ লক্ষ টাকা। ভারত স্বমুক্তি সংস্থা নামে একটি চ্যারিটেবল ট্রাস্টও দিয়েছে ৩০ লক্ষ টাকা। কর্পোরেট দাতাদের মধ্যে কুবের পলিপ্লাস্ট (২৫ লক্ষ) ও অ্যাডভান্স কেমিক্যালস (১১ লক্ষ) উল্লেখযোগ্য।

দলের শীর্ষ নেতারাও নিয়মিত ছোট অঙ্কের অনুদান দিয়েছেন। অরবিন্দ কেজরিওয়াল ১০ হাজার টাকা করে ১২ বার অনুদান দেন। পাঞ্জাবের মন্ত্রী আমন অরোরা, প্রাক্তন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী আতিশী, পাঞ্জাবের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলবীর সিং ও স্পিকার কুলতার সিং সান্ধওয়ানও একইভাবে একাধিকবার অনুদান দিয়েছেন।

বিহারে জনতা দল (ইউনাইটেড) ও লোক জনশক্তি পার্টি (রামবিলাস) অনুদানে অভূতপূর্ব বৃদ্ধি দেখেছে। মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের নেতৃত্বাধীন জেডি(ইউ)-র অনুদান বেড়েছে ৯৩২ শতাংশ- ১.৮১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৮.৬৯ কোটি। প্রোগ্রেসিভ ইলেক্টোরাল ট্রাস্ট দিয়েছে ১০ কোটি, প্রুডেন্ট ইলেক্টোরাল ট্রাস্ট ৫ কোটি এবং সমাজ ইলেক্টোরাল ট্রাস্ট অ্যাসোসিয়েশন ২ কোটি টাকা।

লোক জনশক্তি পার্টি (রামবিলাস), যার নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী চিরাগ পাসওয়ান, অনুদানে যা পেয়েছে তা  প্রায় ৯,৪০০ শতাংশ বৃদ্ধির কাছাকাছি। ২০২৩–২৪ সালে যেখানে দলটি পেয়েছিল মাত্র ১১.৬৭ লক্ষ টাকা, সেখানে ২০২৪–২৫ সালে অনুদান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১.০৯ কোটি টাকায়। এর মধ্যে প্রোগ্রেসিভ ইলেক্টোরাল ট্রাস্ট দিয়েছে ১০ কোটি এবং প্রুডেন্ট ইলেক্টোরাল ট্রাস্ট ১ কোটি টাকা।

এই সামগ্রিক চিত্র স্পষ্ট করে দিচ্ছে, ইলেক্টোরাল বন্ড বাতিল হলেও ভারতের রাজনৈতিক ফান্ডিং কর্পোরেট প্রভাব ও দলগুলির মধ্যে আর্থিক অসমতা এখনও বহাল, বরং কিছু ক্ষেত্রে তা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।