আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও নোবেলজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বিহারে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় পুনর্বিবেচনা (Special Intensive Revision বা SIR) প্রক্রিয়া নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁর আশঙ্কা—যদি এই প্রক্রিয়া যথাযথ সতর্কতার সঙ্গে পরিচালিত না হয়, তবে বিপুল সংখ্যক গরিব ও প্রান্তিক মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। ২২ আগস্ট, শুক্রবার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সেন বলেন, “হ্যাঁ, সময়ে সময়ে নানা প্রশাসনিক কাজকর্ম করা প্রয়োজন। তবে সেই প্রক্রিয়ায় গরিবদের অধিকার পিষে দিয়ে একটি ‘ভালো ব্যবস্থা’ তৈরি করা যায় না। বহু মানুষের হাতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই। তারা ভোট দিতে পারেন না। যদি অল্প কিছু ভুল ঠিক করতে গিয়ে অনেক নতুন ভুল তৈরি হয়, তবে সেটি গুরুতর অন্যায়। এক ভুল শুধরে নিতে গিয়ে সাতটি নতুন ভুল করা কোনোভাবেই ন্যায্য হতে পারে না।”
ভারতের নির্বাচন কমিশন (ECI) কর্তৃক শুরু হওয়া এই বিশেষ উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল ভোটার তালিকাকে আরও নির্ভুল ও ভুলমুক্ত করা। কিন্তু প্রথম দফার খসড়া তালিকা প্রকাশের পর দেখা যায়, বিহারে প্রায় ৬৫ লক্ষ ফর্ম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এর ফলে ভোটার সংখ্যা ৭.৯ কোটির পরিবর্তে নেমে আসে ৭.২৪ কোটিতে। রাজনৈতিক দল ও অধিকারকর্মীরা অভিযোগ তুলেছেন, এই বিপুল নাম বাদ যাওয়া আসলে প্রশাসনিক কঠোর নিয়ম ও সুরক্ষাহীন প্রক্রিয়ার ফল, যা ভোটার বঞ্চনার সমান। এ নিয়ে ইতিমধ্যেই মামলা গড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। আদালত নির্বাচন কমিশন ও বিহার সরকারকে ভোটার ফর্ম বাতিলের মানদণ্ড ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে বলেছে। বিচারপতিরা স্পষ্ট করেছেন যে ভোটাধিকার সংবিধান প্রদত্ত একটি মৌলিক অধিকার, তাই কোনোভাবেই তা অবহেলিত বা খর্ব করা চলবে না।
সম্প্রতি মুখ্য নির্বাচন কমিশনার (CEC) সাংবাদিক বৈঠকে জানান, কমিশন সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার নীতি মেনে কাজ করছে। কোথাও যদি ভুলবশত ভোটার বাদ পড়ে থাকেন, তবে সংশোধনের ব্যবস্থা করা হবে। তবে পদ্ধতি ও তথ্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে কমিশন তার কৌশলকে সমর্থন করেছে। এই প্রসঙ্গ ছাড়াও অমর্ত্য সেন কলকাতার এক আলোচনাসভায় ভারতের যুবসমাজ ও সামাজিক সুযোগ নিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সক্রিয় “যুক্ত সাধনা” বা হিন্দু-মুসলমানের যৌথ অনুশীলনের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। তিনি বলেন, “হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক কেবল সহনশীলতার নয়, বরং সহযোগিতার। সংগীত, সাহিত্য, স্থাপত্য—বহু ক্ষেত্রে আমরা এই ঐতিহ্য দেখতে পাই।”
আলোচনাসভার দিনই প্রকাশিত হয় তাঁর দাদু ক্ষিতিমোহন সেনের লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ ভারতে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা-এর নতুন সংস্করণ। প্রাতিচী ট্রাস্ট কর্তৃক প্রকাশিত এই বইতে অমর্ত্য সেন একটি নতুন ভূমিকা লিখেছেন, যেখানে আজকের ক্রমবর্ধমান সামাজিক-রাজনৈতিক মেরুকরণের প্রেক্ষিতে এই ঐতিহ্যের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেছেন।
এর আগে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, বাংলাভাষী মানুষদের 'বাংলাদেশি' আখ্যা দিয়ে হেনস্থার প্রবণতা বাড়ছে। কৌতুকের ভঙ্গিতে তিনি বলেন, “আমাকেও হয়তো বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, কারণ আমার পৈতৃক ভিটে ঢাকায়।” তবে তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট ছিল—এটি একটি রাজনৈতিক বয়ানের অংশ, যা মুসলমানদের সমাজের জন্য হুমকি হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছে। ৯১ বছর বয়সী এই অর্থনীতিবিদ আবারও মনে করিয়ে দিলেন, ন্যায়সংগত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কেবল শক্তিশালীদের নয়, বরং সবচেয়ে দুর্বলদেরও সুরক্ষা দিতে হবে।
