আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভারতে আল্ট্রা-প্রসেসড ফুড (UPF) বা অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবারের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার রোধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে দ্য ল্যানসেট-এ প্রকাশিত একটি নতুন গবেষণা। ইনস্ট্যান্ট নুডলস, রেডি-টু-ইট খাবার, প্রসেসড মাংস, প্যাকেটজাত রুটি ইত্যাদি খাদ্যপণ্যকে এই শ্রেণিতে ধরা হয়। 

৪৩ জন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে করা তিনটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ভারতে ঐতিহ্যবাহী খাবারের জায়গা দ্রুত দখল করে নিচ্ছে UPF, যার ফলে পুষ্টিহানি হচ্ছে এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগ বাড়ছে। গবেষণা অনুযায়ী, শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন সম্ভব নয়, বাজারে UPF-এর সহজলভ্যতা ও আক্রমণাত্মক বিপণনকেও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালে যেখানে ভারতে UPF-এর খুচরা বিক্রির পরিমাণ ছিল মাত্র ৭,৯৯৬ কোটি টাকা, সেখানে ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.৩ লাখ কোটি টাকায়। এই সময়ে পুরুষ ও নারীর স্থূলতা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

সাম্প্রতিক অনুমান অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৩০% মানুষ এখন স্থূলতায় ভুগছেন। প্রতি দশজনের একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, আর প্রতি তিনজনের একজনের অ্যাবডোমিনাল ডায়াবেটিস রয়েছে। শিশুদের স্থূলতাও বাড়ছে; ২০১৬ সালে যেখানে হার ছিল ২.১%, ২০১৯-২১ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩.৪%।

গবেষণায় বলা হয়েছে, UPF শিল্পই এই সমস্যার প্রধান চালিকাশক্তি। উচ্চ মুনাফার কারণে খাদ্যশিল্পের বড় কর্পোরেশনগুলো মূল খাবারের পরিবর্তে অতিপ্রক্রিয়াজাত পণ্যের বাজার বিস্তারে জোর দিচ্ছে। এতে পুরো খাদ্যব্যবস্থায় UPF-নির্ভর মডেল তৈরি হচ্ছে, যা বিকল্প খাদ্যপদ্ধতিকে পিছিয়ে দিচ্ছে।

গবেষণাপত্রে আরও বলা হয়েছে, কর্পোরেট লবি, বিপণন কৌশল এবং নিয়ন্ত্রণ আইন দুর্বল করার প্রচেষ্টা বর্তমানে ভারতের জন্য বড় হুমকি। দেশের বিদ্যমান খাদ্যনিয়ন্ত্রণ কাঠামো UPF মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী নয়।

গবেষকরা উল্লেখ করেছেন যে বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো বিভিন্ন ফ্রন্ট গ্রুপ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বহুপক্ষীয় উদ্যোগের মাধ্যমে সরকারে প্রভাব বিস্তার করছে। সরাসরি লবিং, সরকারি সংস্থায় প্রবেশ, আইনি মামলা, এবং জনমত প্রভাবিত করার কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে তারা কঠোর নিয়ন্ত্রণ আটকাতে চায়।

গবেষণায় বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে—

UPF ও অতিরিক্ত  চর্বি, লবণ ও চিনি সমৃদ্ধ (HFSS) খাবারের স্পষ্ট আইনি সংজ্ঞা তৈরি

পিক আওয়ারে UPF বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ

প্যাকেটের সামনে সতর্কবার্তা দেওয়া

স্কুলে UPF বিক্রি সীমিত করা


পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়ার চ্যান্সেলর প্রফেসর শ্রীনাথ রেড্ডি দ্য ট্রিবিউন-কে বলেন, “UPF হলো বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তৈরি একটি আসক্তি। এগুলোর বিজ্ঞাপন ও স্পনসরশিপ নিষিদ্ধ করা জরুরি।” তিনি মনে করেন, ভারতে উৎপাদন ও বিপণনের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এই সমস্যা মোকাবিলা সম্ভব নয়।

গবেষণায় বলা হয়েছে, UPF-এর ক্ষতি শুধু পুষ্টিহানিতে সীমাবদ্ধ নয়। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় খাবারের স্বাভাবিক গঠন নষ্ট হয়—যেমন খাদ্যকে বিভিন্ন অংশে ভেঙে ফেলা, রাসায়নিকভাবে পরিবর্তন করা, এক্সট্রুশন প্রযুক্তি ব্যবহার এবং শিল্পোৎপাদিত উপাদান মেশানো। এসব প্রক্রিয়া আমাদের বিপাকক্রিয়া, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

গবেষকদের মতে, অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবারের অতিরিক্ত গ্রহণ স্থূলতা, টাইপ–২ ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, বিষণ্নতা এবং অকালমৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়। প্রফেসর রেড্ডি মন্তব্য করেন, “UPF-এর শিল্প-প্রক্রিয়াজাত গঠন মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, শরীরে প্রদাহ বাড়ায় এবং বিপজ্জনক দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি তৈরি করে। এসব খাবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতার অভূতপূর্ব বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।”

গবেষকরা মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভারতের নীতিনির্ধারকদের দ্রুত ও জোরদার জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।