আজকাল ওয়েবডেস্ক: একশো পঞ্চাশ বছর আগে, ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যখন ‘বন্দে মাতরম’ লেখেন, তখন তিনি কেবল একটি গান রচনা করেননি, বরং এক নতুন জাতীয় চেতনার জন্ম দেন। মাতৃভূমিকে দেবী রূপে কল্পনা করে তিনি একাধারে রাজনীতি ও আধ্যাত্মিকতার মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন। এই গানের মাধ্যমে দেশপ্রেম হয়ে উঠেছিল ভক্তি, আর স্বাধীনতার সংগ্রাম পরিণত হয়েছিল এক পবিত্র উপাসনায়।

‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস থেকেই জন্ম ‘বন্দে মাতরম’-এর। অষ্টাদশ শতকের বাংলার দুর্ভিক্ষ ও বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র একদল সন্ন্যাসীর কাহিনি বলেছেন, যারা মুসলিম শাসক ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে। তাঁদের সংগ্রাম ধর্মীয় কর্তব্যে পরিণত হয়, আর মাতৃভূমি দেবীর আশ্রয়ে হিন্দু জাতির পুনর্জাগরণের প্রতীক হয়ে ওঠে। বিদেশি শাসক— হোক সে মুসলমান বা ইংরেজ— সেখানে এক ‘সভ্যতাগত শত্রু’। এইভাবেই ‘বন্দে মাতরম’ রূপ নেয় এক মুক্তির মন্ত্রে।

খুব দ্রুতই গানটি উপন্যাসের পাতা ছেড়ে রাজপথে পৌঁছে যায়— কংগ্রেস অধিবেশনে, বিপ্লবীদের কারাগারে, এমনকি মৃত্যুর আগে শহিদদের ঠোঁটে। কিন্তু তার ধর্মীয় রূপক মুসলমান সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, কোনও প্রতিমা বা দেবীচিত্রের সামনে মাথা নত করা শিরক হিসেবে গণ্য। ফলে দেশপ্রেমের অনুভূতি যতই প্রবল হোক, মাতৃভূমিকে দেবী রূপে পূজা করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এখানেই তৈরি হয় এক সূক্ষ্ম বিভাজন— মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা বনাম মাতৃভূমির উপাসনা।

জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের হিন্দু মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব সেই পার্থক্যকে পুরোপুরি বোঝেনি। ফলে একসময় যে গান ছিল মুক্তির প্রতীক, সেটিই হয়ে ওঠে আনুগত্যের পরীক্ষাপত্র।

স্বাধীনতার পরে সংবিধান প্রণয়ন সভায় এই জটিলতার সমাধানে সূক্ষ্ম সমঝোতা গড়ে তোলা হয়। রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের সভাপতিত্বে সিদ্ধান্ত হয়— ‘বন্দে মাতরম’ স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে জাতীয় সংগীত না হলেও জাতীয় গান হিসেবে মর্যাদা পাবে। তবে শুধুমাত্র প্রথম দুই স্তবক সরকারি মর্যাদা পায়, কারণ এই অংশগুলিতে দেবীচিত্রের সরাসরি উল্লেখ নেই। এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে সংবিধান প্রণেতারা গানটির আবেগকে সম্মান জানালেও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের চরিত্র বজায় রাখতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু বিতর্ক থেমে থাকেনি।

বর্তমান ভারতে, বিশেষ করে আরএসএসের ভাবাদর্শে প্রভাবিত কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে, ‘বন্দে মাতরম’ আবার এক নতুন অর্থ পাচ্ছে। দেশজুড়ে গানের ১৫০ বছর পূর্তি উদ্‌যাপনকে ঘিরে শুরু হয়েছে এক বৃহৎ সাংস্কৃতিক প্রচারাভিযান, যার উদ্দেশ্য কেবল সাহিত্য বা সংগীত উদ্‌যাপন নয়, বরং জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা নতুন করে নির্ধারণ করা।

সরকার ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, বছরব্যাপী চারটি পর্যায়ে উদ্‌যাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে— স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস ও অন্যান্য প্রতীকী দিনে দেশজুড়ে নাগরিক, ছাত্রছাত্রী ও দোকানদারদের দিয়ে একযোগে ‘বন্দে মাতরম’ গাওয়ানো হবে। অংশগ্রহণকারীরা তাঁদের গান রেকর্ড করে আপলোড করলে সার্টিফিকেটও পাবেন। স্কুল-কলেজগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে গণগানের আয়োজন করতে। এভাবে ‘আনন্দমঠ’-এর পাতা থেকে গানটি এখন রাষ্ট্রের লাউডস্পিকারে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

তবে এই আনুষ্ঠানিক উদ্‌যাপনের আড়ালে রয়েছে এক গভীর নীরবতা— স্বাধীনতার লড়াইয়ে অংশ নেওয়া অসংখ্য মুসলিম ও সংখ্যালঘু স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম যেন ইতিহাস থেকে মুছে যাচ্ছে। ‘ভারত মাতা’ রূপী প্রতীকের ছকে তাঁদের অবদান আর সহজে মানানসই নয়। একসময় যে গান ছিল জাতীয় মিলনের আহ্বান, আজ সেটি অনেকের কাছে বিভাজনের প্রতীক।

বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে মুসলমান চরিত্ররা যে-ভাবে “শত্রু” হিসেবে চিত্রিত হয়েছিল, সেই ভাবনাই আজকের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে নতুন রূপে ফিরে এসেছে। বর্তমান রাজনৈতিক আবহে ইতিহাস যেন পুনর্লিখিত হচ্ছে— যেখানে “মুসলমান” আবারও জাতীয় পুনর্জাগরণের পথে অন্তরায় হিসেবে হাজির।

‘বন্দে মাতরম’ আজ যখন রাষ্ট্রের পতাকার তলায় গাওয়া হয়, তখন তার শব্দের সঙ্গে মিশে থাকে সেই অদৃশ্য প্রতিধ্বনি— উপন্যাসের সেই পুরনো সংঘাতের। একসময়ের সাহিত্যিক কল্পনা আজ বাস্তব রাজনীতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। গানের আড়ালে তাই এখন প্রশ্ন জেগে ওঠে— আমরা কি ইতিহাসকে সম্মান জানাচ্ছি, না কি তাকে এক ধর্মীয় চিত্রে বন্দি করে ফেলছি?

১৫০ বছর পর, ‘বন্দে মাতরম’ আবার জাতির চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে— একদিকে তার অবিস্মরণীয় ঐতিহ্য, অন্যদিকে তার ক্রমবর্ধমান বিভাজন।