আজকাল ওয়েবডেস্ক: এ যেন আক্ষরিক অর্থেই অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো। নতুন প্রযুক্তিতে এবার দ্যুতি ফিরবে দৃষ্টিহীনদের চোখেও! অবিশ্বাস্য লাগলেও, সেই দিন বোধহয় আর খুব বেশি দূরে নেই। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে স্নায়ুবিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এমন এক প্রযুক্তি আবিষ্কারের, যা চিরতরে অন্ধত্ব দূর করতে সক্ষম হবে। অবশেষে সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন সুইজারল্যান্ডের একদল বিজ্ঞানী।

সুইজারল্যান্ডের লোজান-এ সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি-এর গবেষকরা এমন এক স্নায়বিক প্রতিস্থাপন যন্ত্র (নিউরাল ইমপ্লান্ট) তৈরি করেছেন, যা সরাসরি মস্তিষ্কের ভিজুয়াল কর্টেক্সে পৌঁছে দেয় আলো। শুধু তাই নয়। চোখ নষ্ট হয়ে গিয়ে থাকলেও কাজ করে এই প্রযুক্তি। আর এই আলো কিন্তু মোটেও অস্পষ্ট নয়। বরং উচ্চ রেজোলিউশনের। পঠনপাঠন, মুখ দেখে চিনতে পারা থেকে চারপাশে পথ খুঁজে নেওয়া, সবই সম্ভব এই প্রযুক্তিতে।

গবেষকরা জানাচ্ছেন, ডিভাইসটির মূল প্রযুক্তি দাঁড়িয়ে আছে হাজার হাজার সূক্ষ্ম ইলেকট্রোডের উপর। এগুলি মস্তিষ্কের ভিজুয়াল কর্টেক্সে স্থাপন করা হয়। এর সঙ্গে তারবিহীনভাবে যুক্ত থাকে একটি বিশেষ চশমা। এই চশমাই চোখের কাজ করে। কারণ এতে থাকে ক্ষুদ্রাকৃতি ক্যামেরা। সেই ক্যামেরা বাইরের দৃশ্যের ছবি তোলে। এরপর একটি এআই-চালিত সফটওয়ার ছবিগুলিকে মস্তিষ্ক-বান্ধব বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরিত করে। সহজ করে বললে, যন্ত্রটি মস্তিষ্ক যেভাবে স্নায়ুর মাধ্যমে নিজস্ব স্বাভাবিক দৃষ্টির সংকেত পায়, এই যন্ত্রিটিও কৃত্রিম ভাবে সেটিই করে। ফলত, চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সরাসরি মস্তিষ্কে ছবি পৌঁছে যায়।
আরও পড়ুন: নিজেই জানতেন না তিনি অন্তঃসত্ত্বা! মলত্যাগ করতে গিয়ে সন্তানের জন্ম দিলেন মহিলা
আরও পড়ুন: রোগীদের উপুড় করে নিম্নাঙ্গের অন্তর্বাস খুলে নিতেন! তারপর…? বিস্ফোরক অভিযোগ নামী চিকিৎসকের বিরুদ্ধে

এই ইমপ্লান্টের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো, যাঁরা বহু দিন আগে থেকেই চোখে দেখতে পান না, তারাও কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নতুন করে দেখতে পারছেন। বিষয়টির সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিচ্ছে মস্তিষ্কও। ব্রেনে নিউরোপ্লাস্টিসিটি বা নতুন অভ্যাস গ্রহণ করার ক্ষমতার জন্যই এমনটা সম্ভব হচ্ছে। প্রযুক্তিটি সম্পূর্ণ তারবিহীন, দেহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ (বায়োকম্প্যাটিবল) এবং এতে রয়েছে অন্তর্নির্মিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ফলে অতিরিক্ত বা ক্ষতিকর বৈদ্যুতিক উদ্দীপনা কিংবা মাথায় শক লাগার ঝুঁকি নেই। চিকিৎসকদের মতে, এর ফলে দীর্ঘমেয়াদি ভাবে ব্যবহার করা যাবে যন্ত্রটি।

তবে এখানেই শেষ নয়। গবেষক দল ভবিষ্যতে প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করার পরিকল্পনা করছেন। শুধু ইনপুট সেন্সর পরিবর্তন করলেই এই যন্ত্র ইনফ্রারেড বা অতিবেগুনি আলো শনাক্ত করতে পারবে। অর্থাৎ অন্ধত্ব নিরাময়ের পাশাপাশি মানুষের স্বাভাবিক ইন্দ্রিয় সীমার বাইরেও নতুন দৃষ্টিশক্তি যোগ করা সম্ভব হবে। অর্থাৎ অদৃশ্য অতিবেগুনি রশ্মিও সহজেই দেখতে পাবে মানুষ।

ইতিহাসের দিক থেকে দেখলেও এই আবিষ্কার অনন্য। ১৯৭০-এর দশক থেকেই এই ধরনের কর্টিকাল ইমপ্লান্টের ধারণা ছিল। কিন্তু তখনকার যন্ত্রগুলি কেবল কয়েক ঝলক আলো তৈরি করত। স্পষ্ট করে কিছু দেখাতো না। তাছাড়া প্রযুক্তি এতো উন্নত ছিল না। ফলে মাথায় এই ধরনের যন্ত্র বসানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। বহু দশকের গবেষণা এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পর অবশেষে এমন একটি সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছেন বিজ্ঞানীরা যা সভ্যতার গতিপথকে একেবারে পাল্টে ফেলতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রযুক্তি শুধু চিকিৎসাশাস্ত্রেই নয়, মানব সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাসেও মাইলফলক হয়ে থাকবে। এটি প্রমাণ করে, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির মাধ্যমে মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ নতুন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভ্যাস রপ্ত করতে পারে।
সব মিলিয়ে, অন্ধকার থেকে রঙিন আলোকিত জগতে ফেরার এই যাত্রা নিঃসন্দেহে মানবজাতির জন্য এক অভূতপূর্ব সাফল্য। বিজ্ঞানীরা ফের একবার দেখিয়ে দিলেন, অসম্ভবকে সম্ভব করার ক্ষমতা প্রযুক্তির হাতেই নিহিত।