সুর, যন্ত্রণা আর এক অসমাপ্ত প্রেমের গল্প- এই তিনের মাঝেই যেন বেঁচে ছিলেন সুলক্ষণা পণ্ডিত। মঙ্গলবার, মুম্বইয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন এই কিংবদন্তি গায়িকা-অভিনেত্রী। বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। কিন্তু এই মৃত্যুকে ঘিরে রইল এক অদ্ভুত কাকতালীয়তা- ৬ নভেম্বরই প্রয়াত হয়েছিলেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ, অভিনেতা সঞ্জীব কুমার। শেষমেশ সেই একই দিনেই, বহু বছর পর চিরনিদ্রায় গেলেন সুলক্ষণা। যেন প্রেম ও বেদনার এক অপার্থিব পুনর্মিলন।

 

১৯৫৪ সালের ১২ জুলাই ছত্তিশগড়ের রায়গড়ে জন্ম সুলক্ষণার। নয় বছর বয়সেই শুরু হয়েছিল তাঁর সঙ্গীতযাত্রা। ১৯৬৭ সালে ‘তকদীর’ ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে তাঁর প্রথম গান ‘সাত সমন্দর পার সে’ তাঁকে রাতারাতি পরিচিতি এনে দেয়। কণ্ঠে ছিল কোমলতা, ছিল মায়া। আর সেই সুরেই তিনি ধীরে ধীরে জায়গা করে নেন বলিউডের সেরা প্লেব্যাক গায়িকাদের তালিকায়।

 

 

 

১৯৭০ থেকে ১৯৮০। বলিউডের সোনালি দশক। সেই সময়ের গানে যখন লতা-আশার সুরে দোলা দিত ভারতবর্ষ, তখনই নিজের অনন্য মাধুর্য ও ব্যথাভরা সুরে জায়গা করে নিয়েছিলেন সুলক্ষণা পণ্ডিত। “তু হি সাগর, তু হি কিনারা”, “বন্দি রে”, “উলঝন” কিংবা “সাঁওধি বাত” প্রতিটি গানে ছিল তাঁর গলার স্নিগ্ধতা, বিষণ্ণতা আর গভীর রোম্যান্স।

 

১৯৭৬ সালে ‘সঙ্কল্প’ ছবির গান ‘তু হি সাগর তু হি কিনারা’-র জন্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান তিনি— সেই গান আজও বয়ে আনে এক অদ্ভুত আবেগ।তবে সুলক্ষণার প্রতিভা শুধু গানে আটকে ছিল না। তিনি ছিলেন রুপোলি পর্দার এক কোমল, মায়াময় উপস্থিতি। ‘হেরা ফেরি’, ‘আপনাপন’, ‘খানদান’, ‘ওয়াক্ত কি দেওয়ার’— একের পর এক ছবিতে রাজেশ খান্না, জিতেন্দ্র, শশী কাপুর, বিনোদ খান্না, শত্রুঘ্ন সিনহার মতো তারকাদের বিপরীতে অনায়াস অভিনয়ে নজর কাড়েন।১৯৭৮ সালে উত্তমকুমারের বিপরীতে বাংলা ছবি ‘বন্দী’-তে অভিনয় করে দেখিয়েছিলেন তাঁর বহুমুখী প্রতিভা।

 


তাঁর জীবনের অমর অধ্যায় নিঃসন্দেহে সঞ্জীব কুমার। শোনা যায়, অভিনেতাকে নিঃস্বার্থ ভালবেসেছিলেন তিনি, কিন্তু সেই প্রেম কখনও পরিণতি পায়নি। সঞ্জীব কুমারের মৃত্যুর পর যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সুলক্ষণার জীবনও। ধীরে ধীরে সরে গিয়েছিলেন বলিপাড়ার ঝকমকে আলো থেকে, নিঃশব্দে হারিয়ে গিয়েছিলেন গ্ল্যামারের দুনিয়া থেকে। বলিউডের একসময়ের ঝলমলে কণ্ঠস্বর পরিণত হয়েছিলেন নিঃসঙ্গতার প্রতীকে।
 ১৯৭৫ সালে ‘উলঝন’ ছবির শ্যুটিং চলাকালীন সহ-অভিনেতা সঞ্জীব কুমারের প্রেমে পড়েছিলেন সুলক্ষণা। কিন্তু সঞ্জীবের হৃদয় ততদিনে অন্য কারও জন্য। প্রস্তাব দিয়েও ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। আর সেই প্রত্যাখ্যানেই যেন থেমে যায় সুলক্ষণার জীবনের সুর। তিনি আর কোনওদিন বিয়ে করেননি।

 

১৯৮৫ সালে সঞ্জীব কুমারের মৃত্যু তাঁর জীবনে যেন চূড়ান্ত অন্ধকার নামিয়ে আনে। বিষণ্ণতায় ডুবে সুলক্ষণা ধীরে ধীরে সরে যান আলো থেকে, রুপোলি দুনিয়া থেকে। ভাগ্যের কী এক অদ্ভুত পরিহাস, সঞ্জীব কুমার মারা গিয়েছিলেন ১৯৮৫ সালের ৬ নভেম্বর। আর ঠিক সেই তারিখেই, চল্লিশ বছর পর, ২০২৫ সালের ৬ নভেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন সুলক্ষণা পণ্ডিত।

 

তাঁর ভাই, জনপ্রিয় সঙ্গীতপরিচালক জতিন পণ্ডিতের কথায়, “দিদি অনেক কষ্টে ছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত খুব শান্তিতে গেলেন।” বলিউডের শিল্পীমহল শোকের ছায়ায় আবৃত। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মুগ্ধ করা সেই কণ্ঠ আজ চুপ, কিন্তু তাঁর গাওয়া গানগুলো আজও বাজে রেডিওর মৃদু সুরে, চিরন্তন স্মৃতির মতো।