২৪ নভেম্বর সোমবার অভিনেতা রবি ঘোষের জন্মদিন। বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হত ৯৪।  আজকাল ডট ইন-এর পাতায় তাঁর স্মৃতিচারণায় অভিনেতা কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়

 

“আজ রবি ঘোষের জন্মদিন। আমার রবি কাকু। রবি কাকু মানেই আমার কাছে অজস্র স্মৃতি। ওঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘ বছরের আলাপ ছিল। আমার কেরিয়ারের প্রথম ছবিতেও যেমন ওঁকে পেয়েছিলাম, তেমনই ওঁর অভিনীত শেষ ছবিতেও আমি ছিলাম! রবি কাকুর সমন্ধে কোথা থেকে শুরু করব আর কোথায় শেষ করব, আজও তা বলতে বা লিখতে বসলে ছোট শিশুর মতো হাতড়ে যাই। যাই হোক, আমার বাবার বন্ধু থেকে সহ-অভিনেতা হলেও রবি কাকু আমার সঙ্গে যেভাবে মেলামেশা করতেন, তাতে মনে হত উনি কাকু নন, আমার বন্ধু। আমিষ গন্ধমাখা জোকস ক্র্যাক করা থেকে জমাটি আড্ডা, সব মিলিয়ে এমন হুল্লোড় মাতিয়ে রাখতেন যে রবি কাকু সামনে থাকলেই মন ফুরফুরে।  কোনওদিন দেখিনি পরনিন্দা করছেন। কোনওদিনও না। বিরাট উদার মনের মানুষ ছিলেন। হয়তো কোথাও আউটডোর শুটিংয়ে যাচ্ছি, রাস্তার ধারে ধাবা দেখলেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে সবাইকে মনমতো পেটপুরে খাওয়াতেন। তার মানে এর এই অর্থ নয় যে দ্যাখো আমি কত টাকা উপার্জন করি। লোকদেখানো স্বভাব রবি ঘোষের ছিল না। জোর গলায় বলছি, সেই সময়ে ইন্ডাস্ট্রিতে খুব কম শিল্পী-ই বাকি ছিলেন যাঁদের রবি ঘোষ কখনও 'ট্রিট' দেননি। 

 

 

 

রসবোধ আর রবি কাকু যেন হাত ধরাধরি করে চলত। তেমনই ছিল রুচিবোধ। আর ভীষণ আধুনিকমনস্ক ছিলেন। উৎপল দত্ত, সত্যজিৎ রায়, তপন সিনহা, কমলকুমার মজুমদারের মতো ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে যাঁর ওঠাবসা ছিল, তিনি তো এরকম মানুষ-ই হবেন। নইলে যে লোকটা সত্যজিৎ-তপন সিনহার মতো পরিচালকের ছবিতে এত বিখ্যাত সব চরিত্রে ওরকম কালজয়ী অভিনয় করেছেন, তিনি জীবনের শেষ পর্যায় কেন ছোটপর্দায় কাজ করবেন? কারণ ওই যে যুগের সঙ্গে তাল মেলানো। পাশাপাশি মঞ্চ, যাত্রা তো ছিলই। রবি কাকা একটা কথা বলতেন, 'মিডিয়ামটা কোনও ফ্যাক্টর নয়, অভিনয় প্র্যাকটিস করাটাই আসল। প্র্যাকটিস, প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্র্যাকটিস!' 

 

 


রবি কাকুর মতো আমারও অভিনয়ের গুরু ছিলেন উৎপল দত্ত। কিন্তু তাই বলে কেউ যেন ভেবে না বসেন, আমার অভিনয় ক্ষমতা রবি ঘোষের সমান। আমি ওঁর নখের যোগ্য নই! যাক সে কথা। বহু দর্শক আছেন যাঁরা মনে করেন রবি ঘোষ শুধুই কমেডিয়ান, আমি বলব এটা সেই সব দর্শকের অশিক্ষা! স্রেফ অশিক্ষা! ভারতবর্ষের সর্বকালের সেরা ১০ জন অভিনেতার নাম আছে এবং থাকবে রবি ঘোষের। আমার কথা ছেড়ে দিন, অমিতাভ বচ্চনের মতো অভিনেতা একাধিক সাক্ষাৎকারে রবি ঘোষের অভিনয় প্রতিভার কথা বলেছেন। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এসে নিজের ভাষণে রবি কাকুর শক্তিশালী অভিনয় নিয়ে মন্তব্য করেছেন। 

 

 


রবি ঘোষের কাছে কত বলিউডের ছবির প্রস্তাব এসেছিল এক সময়ে। উনি গিয়েছিলেনও বোম্বে। তারপর হুট্ করে চলেও এসেছিলেন। কেন? বলতেন, ‘কলকাতায় আড্ডা না মারতে পারলে বাঁচব না। দরকার নেই আমার বোম্বেতে কাজ করে।’ বিশ্বাস করুন, যদি রবি কাকু বোম্বেতে কাজ করতেন, সেখানেও দারুণ সফল হতেন। যাই হোক, বলিপাড়া নিয়ে নানান কিসসা আমাদের শোনাতেন রবি কাকু। অমিতাভ বচ্চন-জয়া বচ্চনের সঙ্গে ওঁর যে ভীষণ সখ্যতা ছিল, তা অনেকেরই জানা। অমিতাভ বচ্চনের বিষয়ে আমাকে একবার শুধু বলেছিল, " অমিতকে আমি বলেছি, ঘরের লক্ষ্মী-ই কিন্তু আসল।' মাফ করবেন, এর থেকে বেশি কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব না। 

 

 

 


শেষ করি, রবি কাকুর একটি ঘটনা দিয়, যা জানলে আরও পরিষ্কার হবে আপনাদের কাছে অনুজদের জন্য কতটা স্নেহ, ভালবাসা নিজের বুকে পুষে রাখতেন তিনি। আমি বহু বছর ধরে গানের শো করি। রবি কাকুও একটা সময় চুটিয়ে নানান স্টেজ শো করতেন। ছোট ছোট স্কিট। একবার বজবজে গিয়েছি। শো দেখতে মাঠ ভেঙে পড়েছে মানুষ। আমাকে রবি কাকা এসে বলল,  ‘এই শোন না, তোর পারফরম্যান্সের আগে আমাকে পারফর্ম করতে দে। নইলে তোর অনুষ্ঠানে যা জাঁকজমক, তারপর আমারটা আর কেউ দেখবে না!’ ভাবুন, রবি ঘোষ বলছে এই কথা। শুনে তো আমি লজ্জায় আর বাঁচি না। হাসতে হাসতে ওঁকে বলেছিলাম, ' এসব খবরদার জোরে বলো না, শুনলে আমি মার খেয়ে যাব। যাই হোক, তুমিই আগে পারফর্ম করো, কিন্তু আমার দু'টো গান শুনে যেও।' এবং বসে এক মনে শুনেওছিলেন আমার গাওয়া গান। কী দরকার ছিল এটা করার ওঁর? কিন্তু করেছিলেন। এই ছিল আমার রবি কাকু! 

 

এরপর তো চলেই গেলেন। আগাধ পাণ্ডিত্য, রসবোধ, মাটিতে পা রেখে চলা... রবি কাকুকে ভোলা মুশকিল।বেঁচে থাকলে আজ তাঁর ৯৪তম জন্মদিন হত। রবি কাকু, তুমি যেখানেই রয়েছ, আশা করি ভাল আছো। চারপাশটাকে তোমার মতো করেই আলোয়, মজায়, অনাবিল হাসিতে ভরিয়ে রেখেছ। জন্মদিনে আমার প্রণাম নিও।”